
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই: ইতিহাস ও মানবতার পক্ষের আহ্বান
আমাদের শান্তি-সুখ করতে চায় লুঠতরাজ
জোটবাধো তৈরি হও যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই,
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ...’
—সুবীর পান্ডের কথা আর সলিল চৌধুরী সুরে এই গান কেবল কাব্যিক উচ্চারণ নয় বরং এটি বিশ্বশান্তির পক্ষে মানবতার এক চিরন্তন ঘোষণা। গীতিকার এই আহ্বান জানিয়েছিলেন যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধে জয় থাকলেও মানবতা বারবার পরাজিত হয়েছে।
১৮৫৯ সালে ইতালির সলফেরিন নামক স্থানে সংঘটিত যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে একজন সুইস নাগরিক হেনরি ডুনান্ট (Henry Dunant) গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন। আহত ও রক্তাক্ত সৈনিকদের আহাজারি তার মানবিকতাকে নাড়া দেয়। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তিনি আহতদের সেবা করতে এগিয়ে আসেন।
তিনি শুধু তৎকালীন একটি যুদ্ধের জন্য দায়বদ্ধ থাকেননি; তিনি চাইতেন ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলোও যেন মানবিক ন্যূনতম নিয়মের মধ্যে থাকে। এই চিন্তা থেকেই তিনি লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘A Memory of Solferino’, যেখানে যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা ও সাধারণ মানুষের রক্ষা নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দেন।
ডুনান্টের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় International Committee of the Red Cross (ICRC) এবং ১৮৬৪ সালে প্রণীত হয় ঐতিহাসিক জেনেভা কনভেনশন, যা আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যুদ্ধকালীন সময়ে অনুসরণ করে। এই আইন অস্ত্রধারী পক্ষগুলোর মানবতা রক্ষায় ন্যূনতম সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়।
এমনই আরেকটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখেছেন সম্রাট অশোক। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা, রক্তপাত ও মানবিক বিপর্যয় দেখে তিনি তার তরবারি ফেলে দেন, সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসা ত্যাগ করে গ্রহণ করেন শান্তির বুদ্ধবাদী পথ। তিনি উপলব্ধি করেন—যুদ্ধ মানেই রক্ত, কান্না, ধ্বংস; আর শান্তিই প্রকৃত শক্তির প্রকাশ।
ইতিহাস এমন অনেক উদাহরণে ভরপুর, যেখানে মানুষ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা দেখে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে যুদ্ধ—যা ধ্বংস আনে, সভ্যতা পেছনে ফেলে, মানবতাকে ক্ষতবিক্ষত করে। যুদ্ধ কখনোই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারে না, বরং ঘরে ঘরে শোক ও সহিংসতার উত্তরাধিকার রেখে যায়।
যুদ্ধকে আমরা কীভাবে দেখি?
যুদ্ধ—এই শব্দটি একদিকে যেমন বীরত্ব ও প্রতিরোধের চিত্র আঁকে, তেমনি অন্যদিকে এর অর্থ দাঁড়ায় রক্তপাত, ধ্বংস, কান্না আর মানবিক বিপর্যয়। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যুদ্ধ যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে থেকেছে; কখনো রাজাদের অযৌক্তিক লালসার ফল, কখনো শাসকদের দমননীতি প্রতিহত করতে জনগণের প্রতিরোধ—প্রতিবিপ্লব হিসেবে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব অধিকাংশ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে রাষ্ট্র দখল, সীমানা প্রসারণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কিংবা ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় হিংসা চরিতার্থ করার জন্য। কালের প্রবাহে ধর্মও হয়ে উঠেছে যুদ্ধের এক বড় উপলক্ষ।
ধর্মের নামে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা, মতবাদের একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি কিংবা মানুষকে জোর করে নির্দিষ্ট ধর্মমতে পরিচালিত করার জন্য অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইতিহাসে নথিভুক্ত রয়েছে। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ আশাবাদী হয়েছিল যে, যুক্তিবাদ, মানবতা ও সভ্যতা মানুষকে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে শান্তির পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যুদ্ধ থামেনি বরং তার ধরন পাল্টেছে।
বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বহু সময় নিজেদের নীতিমালা, আদর্শ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বা কথিত সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে বহু দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ ও সংঘাত সংঘটিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি তার নির্মম উদাহরণ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব শান্তি