
ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পৃথিবী মাত্র ৮৯ সেকেন্ড দূরে!
বিশ্বজুড়ে এখন যুদ্ধের যে দামামা বাজছে, তা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে আশঙ্কার। যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ একবার ছুটলে তা দাবানলের মত বিশ্বকে গ্রাস করতে উদ্যত হবে। এর কারণ পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ যা সমগ্র পৃথিবীকে মুহূর্তে ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে। অনেকে বলেন এই ভয়ই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এখন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে এটা আংশিক সত্য। একে একমাত্র সত্য মনে করলে পুরো ঠান্ডাযুদ্ধের কালে বিশ্বব্যাপী যেসব শান্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ও ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রভাবকে অস্বীকার করা হয়।
যদিও একটি মত খুবই প্রচলিত– পারমাণবিক বোমার সম্ভাব্য ধ্বংসযজ্ঞ যা আক্রমণকারী ও আক্রান্ত উভয়কেই গ্রাস করবে– সেটাই মানবজাতির রক্ষাকবচ হয়েছে। এ কথাটা আপাত সত্য মনে হলেও যুক্তির বিচারে ততটা টেকসই নয়। পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক শাসকগোষ্ঠি ও অস্ত্রব্যবসায়ীরা সুবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সরে এসেছে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। দীর্ঘকাল ধরে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ, তাদের প্রতিবাদ, যুদ্ধের বিরোধিতা ও শান্তির দাবি এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড এস. মেয়ের ‘জ্যাকোবিন’ সমায়িকীতে (উই নিড এ নিউ পিস মুভমেন্ট টু প্রিভেন্ট নিউক্লিয়ার ওয়ার, ৬ অগাস্ট ২০২৪) লিখেছেন, “১৯৫০-এর দশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ধ্বংসাত্মক পরামাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর প্রতিক্রিয়ায়। বক্তৃতা, শিক্ষা, মিছিল, আইন অমান্য ইত্যাদিসহ একটা বিস্তৃত সামাজিক আন্দোলন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
“এই আন্দোলন জন এফ. কেনেডির প্রশাসনকে পামাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা বন্ধের চুক্তি করতে শক্তি ও উৎসাহ জুগিয়েছে। যদিও এটা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় সমাপ্তি টানেনি, টেস্ট ব্যান ট্রিটি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার লাগাম টেনে ধরেছে। পরবর্তীকালে ব্যালিস্টিক মিসাইল-বিরোধী আন্দোলন ১৯৭০-এর দশকে রিচার্ড নিক্সনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তিতে বসতে চাপ তৈরি করেছে। যা ঠান্ডাযুদ্ধের কালে অস্ত্রবাবদ ব্যয় ও বিপদের রাশ টেনে ধরেছিল।”
পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের উদ্যোক্তা কিন্তু ম্যানহাটান প্রজেক্টের সেইসব বিজ্ঞানীরা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন ওপেনহাইমার, যাদেরকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, লিও শিলার্ড ও এনরিকো ফার্মির মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী, যাদের গবেষণার পরিণতি ছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ। ১৯৪২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট। জাপানে ফেলা পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞে বিহ্বল আলবার্ট আইনস্টাইন ও ওপেনহাইমারসহ তৎকালীন পারমাণবিক বিজ্ঞানীগণ তৈরি করেন ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটোমিক সাইন্টিস্টস’। ১৯৪৭ তারা একটি ডুমসডে ক্লক চালু করেন যা একটি প্রতীকী ঘড়ি। এই ঘড়ির কাঁটা প্রতি বছর নির্দেশ করে পৃথিবী ও মানবসভ্যতা ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যরাত থেকে কত মিনিট দূরে আছে। ১৯৪৭ সালে ডুমসডের এই ঘড়ির কাঁটা মহাধ্বংসযজ্ঞ থেকে ৭ মিনিট দূরে ছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে ধ্বংসের উপাদান হিসেবে পারমাণবিক বোমার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে। ১৯২৩ ও ১৯২৪ সালে এই ঘড়ির কাঁটা মহাধ্বংসযজ্ঞ থেকে মাত্র ৯০ সেকেন্ড দূরত্বে চলে আসে। আর এ বছর তা আরও এক সেকেন্ড এগিয়ে ডুমসডে ক্লক বর্তমানে অবস্থান করছে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যরাত থেকে মাত্র ৮৯ সেকেন্ড দূরে। এই ঘড়ির ৭৮ বছরের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে নিকটতম দূরত্ব। (দা ডুমসডে ক্লক জাস্ট মুভড ক্লোজার টু মিডনাইট, জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস ও ড্যানিয়েল হোলজ, টাইম সাময়িকী, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫)
লক্ষ্যণীয়, ১৯৭০-এর দশকে এবং পরে আবার নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে এই বিপদ সবচেয়ে কমে গিয়েছিলে। যা স্পষ্টতই সেসময়কার যুদ্ধবিরোধী চেতনা প্রচারের ও শান্তির জন্য আন্দোলনের ফসল। এরপর আত্মতৃপ্তির ফাঁদে পড়েছে মানুষ। ফলে বর্তমানে আবার এই যুদ্ধের বিরোধিতা ও শান্তির দাবির প্রয়োজন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ এখন যেরকম ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে তা খুবই উদ্বেগের। মিয়ানমারে ও ইউক্রেইনে যুদ্ধ, গাজায় হামলা ও গণহত্যা এবং সাম্প্রতিককালে ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধাবস্থা ইত্যাদি যে কোনো সময় পারমাণবিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। সেটি কেবল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই হবে না, হবে শেষ যুদ্ধও। কারণ এরপর পৃথিবীতে যুদ্ধ দূরে থাক, মারামারি করার মতও কেউ থাকবে না। প্রচলিত আছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে আইনস্টাইন এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি উত্তর বলেছিলেন, “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি ও পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি।”
এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি এবং সেই সঙ্গে শান্তির আহ্বান ও দাবি ছড়িয়ে দেয়াই দেশে দেশে মানুষের অন্যতম কর্তব্য– পারমাণবিক বিজ্ঞানীগণ সেটা অনুভব করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই। আর যুদ্ধবিরোধী দাবিকে শক্তিহীন মনে করার কোনো কারণ নেই। এই দাবিই যুদ্ধবাজদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। যুদ্ধ ঠেকাতে যুদ্ধ আসলে যুদ্ধবাজদের খেলায়ই অংশগ্রহণের শামিল। শান্তির জন্য ব্যাপক গণআন্দোলন এই ধ্বংসাত্মক খেলাকে অকার্যকর করার ক্ষমতা রাখে। তাই শান্তির আহ্বান এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
ডেভিড মেয়ের আরও লিখেছেন, “রাজনীতিকরা সংগঠিত আন্দোলনকে ধর্তব্যের মধ্যে নেন, কেবল নির্বাচনকে নয়। প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার সবচেয়ে ভাল বলেছেন এভাবে, ‘দীর্ঘমেয়াদে সরকার নয়, জনগণই শান্তিকে এগিয়ে নিতে বেশি কাজ করছে। ... মানুষ এতটা বেশি শান্তি চায় যে, আজকাল সরকারকে পথ ছেড়ে দিতে হবে জনগণের ইচ্ছা পূরণের জন্য।’”
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্বযুদ্ধ
- পারমাণবিক অস্ত্র