বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, দুরবস্থা, দ্বৈতনীতি, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির ভেতর বাংলাদেশ কেমন আছে? ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা, আবার চুলা থেকে টগবগে কড়াই—এই তো চলছে এ দেশের জনগণকে নিয়ে। বরং যত দিন যাচ্ছে কড়াইয়ের তেল ও চুলার আগুন উভয়ই আরও উত্তপ্ত ও পরাবাস্তব হয়ে উঠছে। এখানে যা হচ্ছে তা দেখে আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না যে আমরা একবিংশ শতকে রয়েছি। যে সময়ে মানুষ মঙ্গল গ্রহে দূরনিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার-সমৃদ্ধ রোবোটিক বাহন পাঠিয়ে দিচ্ছে, ঠিক সে সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমরা কোন দিকে যাব। ডানে ঝুঁকব, না বামে, নাকি মাঝামাঝি স্থির থাকব? আমরা অবিরত দোলাচলে আছি মালিকানা নিয়ে। এই বাংলা কার, যাঁরা যুদ্ধ করে বাঙালিকে মুক্ত করেছিলেন, তাঁদের? নাকি যাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধের দোসর ছিলেন, তাদের?
মাঝামাঝি কোনো জিনিসই ভালো নয়। অন্তত কষ্টকর হলেও, এসপার-ওসপার একটা হয়ে যাওয়াটা অধিক স্বস্তির। তাতে আপনার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। কিন্তু দেশে কী হচ্ছে? একদল শাহবাগে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না বলে ধমকাধমকি করছে। আরেক দল পরের দিন সমাবেশ ডেকে জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন করছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত কেন জাতীয় সংগীত নিয়ে দ্বিধা ও ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়? তাহলে তারা কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মানতে পারছে না? তারা কি তবে রাষ্ট্রদ্রোহী? বাংলাদেশ যদি আফগানিস্তানের মতো ধর্মীয় চরমপন্থার হাতে সমর্পিত হয় এবং আফগানিস্তানে যেমন সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে যদি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করা সবকিছুকেই উড়িয়ে দেওয়া হয় শতবর্ষী বটগাছ কেটে ফেলার মতো করে, তাতেও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে দেশটা শেষ পর্যন্ত একটা দিকে গিয়ে দাঁড়াল। হোক সেটা চরমপন্থা ও অন্ধকারের আধার। অন্তত দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে যাবে, এই চিন্তায়-চিন্তায় ঘুম ও শান্তি হারাম হতো না। এ যেন মুমূর্ষু রোগীর দশা, যে চির প্রস্থান নিচ্ছে না, কিন্তু স্বজনদের অসম্ভব মানসিক চাপের ভেতর রেখেছে। এমন মানসিক চাপের ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করা দুরূহ ব্যাপার। কেউ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছে না।
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উল্টো দিকে প্রগতিশীল শক্তির একটা উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু সেই শক্তি খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মধ্যপন্থার শক্তিটি বড্ড সুবিধাবাদী। তারা ক্ষমতা যেদিকে, সেদিকেই ছাতা মেলে ধরে। এই সত্য প্রত্যেক বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বেলায় সত্যি। মধ্যপন্থার শক্তি এই মুহূর্তে কিছুটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলছে, কোথাওবা তারা নিষ্ক্রিয়। আর ওদিকে বামপন্থী শক্তি প্রকৃতপক্ষে কোনো শক্তি হিসেবেই বাংলাদেশে দাঁড়াতে পারেনি, তাই তারা চরমপন্থার বিপরীতে কোনো বয়ান সৃষ্টি করতে পারছে না। আর এ কারণেই দেখা যায়, ধর্মীয় অরাজনৈতিক দলও রাজপথে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশ করছে, কথায় কথায় সড়ক অবরোধ করছে। এর-তার নামে রাস্তাঘাটে গরু-ছাগল জবাই করে জিয়াফত করছে। দুঃখের বিষয়, এসব যারা করছে তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ ও কিশোর।
ধর্মীয় চরমপন্থা ছাড়াও কিশোরদের দেখা যাচ্ছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে মারামারি করছে। এক কলেজের নামফলক আরেক কলেজের ছেলেরা খুলে নিয়ে যাচ্ছে। যেসব কিশোর লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তারা কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে রাজধানীর ভেতর প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। দিনদুপুরে ছিনতাই, রাহাজানি, খুনোখুনি চালাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে তারা আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কদিন আগেই খবরে পড়লাম, টাকা চুরি করার সময় খালা দেখে ফেলেছে বলে এক কিশোর দুই খালাকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে ফেলেছে!
নারী ও কন্যাশিশুদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তো মাঝে মহামারির মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল। তনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার তো হলোই না। নৃশংসভাবে সাগর-রুনিকে হত্যার বিচারও আর হবে কি না সন্দেহ রয়েছে! আরও শত শত উদাহরণ এনে জড়ো করা যায়, শেষ হবে না। এত অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার! বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই চলছে, ক্রমেই বেড়েছে! তো এসব দেখে কি আপনার মনে হয় যে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর বাস্তবতার ভেতর আছেন? আমার তো মনে হয়, আমরা ডিসটোপিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই দুঃসময় কবে শেষ হবে, সেটা কারও জানা নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর ভুলের পর ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার খেসারত দিতে দিতে আজ আমরা এমন এক জায়গায় উপনীত হয়েছি, এমন এক রাষ্ট্র নির্মাণ করেছি, যেখানে নাগরিক অধিকার বলতে কিছু তো নেই-ই, নাগরিক সুবিধাও হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ।