
বজ্রপাতঝুঁকি হ্রাসে প্রয়োজন সমন্বিত কৌশল
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাত একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত এক দশকে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের জন্য একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী এবং খোলা মাঠে কর্মরত কৃষক-শ্রমিকদের জন্য বজ্রপাত এখন নিয়মিত আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংঘটিত একটি মর্মান্তিক ঘটনায় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৭ জন বরযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে, যারা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিল।
একই বছর এপ্রিল মাসে সুনামগঞ্জের চারটি উপজেলায় ধান কাটার সময় বজ্রপাতে চারজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আরো পেছনে তাকালে ২০১৬ সালের মে মাসের ভয়াবহ ঘটনা আমাদের স্মরণে আসে, যখন মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে বজ্রপাতে ৮১ জন প্রাণ হারায়।
বাংলাদেশে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ অনেক ঘটনাই রেকর্ড হয় না।
তবে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে গড়ে প্রতিবছর ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতে ৩২৯ জনের মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৭.৫২ শতাংশ ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সবচেয়ে বেশি কৃষক, মৎস্যজীবী ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভৌগোলিক বিচারে হাওরাঞ্চল, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বজ্রপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। এপ্রিল-মে মাসে যখন কৃষকরা জমিতে ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন, সে সময়ে বজ্রপাতে আক্রান্তের ঝুঁকি তাঁদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
বজ্রপাত প্রকৃতির একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক নিঃসরণ প্রক্রিয়া, যেখানে মেঘ থেকে মেঘে অথবা মেঘ থেকে ভূপৃষ্ঠে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক চার্জ প্রবাহিত হয়। একটি সাধারণ বজ্রপাতে গড়ে তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন ভোল্টের বিদ্যুত্শক্তি নিঃসৃত হয়, যার বিদ্যুত্প্রবাহের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার অ্যাম্পিয়ার এবং এর গতি ঘণ্টায় ২২০ মাইল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
এই শক্তিশালী নিঃসরণের পেছনে মূলত তিনটি বৈজ্ঞানিক কারণ দায়ী : প্রথমত, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তারতম্য। দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমের পর যখন বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়, তখন ভূপৃষ্ঠের উত্তপ্ত বায়ু দ্রুত ওপরে উঠে যায়। এই উষ্ণ বায়ু যখন উপরিস্থিত আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শে আসে, তখন তা দ্রুত ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। এই তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, মেঘের ভেতরে জলকণার আধান বিভাজন প্রক্রিয়া। যখন জলীয় বাষ্প ওপরে উঠে মেঘের নিচের স্তরে পৌঁছায়, তখন ভারী জলকণাগুলো ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আধান লাভ করে; অন্যদিকে হালকা জলকণাগুলো সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আধানপ্রাপ্ত হয়। এভাবে মেঘের ওপরের অংশে ধনাত্মক এবং নিচের অংশে ঋণাত্মক আধান সঞ্চিত হয়। তৃতীয়ত, এই বিপরীত আধানের মধ্যে যখন বিভব পার্থক্য একটি সীমা অতিক্রম করে (সাধারণত ১০ হাজার ভোল্ট প্রতি সেন্টিমিটার), তখন বাতাসের রোধকতা ভেঙে যায় এবং তীব্র বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বজ্রপাত হিসেবে দেখি। তবে সব বজ্রপাত ভূপৃষ্ঠে আঘাত করে না; ক্লাউড টু ক্লাউড ডিসচার্জও ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে বজ্রপাতের উচ্চ সংঘটনের পেছনে একাধিক পরিবেশগত ও ভৌগোলিক কারণ কাজ করছে। বাংলাদেশের ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু, বিশেষ করে প্রাক-মৌসুমি (মার্চ-মে) এবং মৌসুমি (জুন-সেপ্টেম্বর) কালে প্রচুর বজ্রঝড় সংঘটিত হয়। এই সময়ে বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন বজ্রমেঘ সৃষ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচুর নারকেল ও তাল গাছ দেখা যেত, যা প্রাকৃতিক বজ্রনিরোধকের ভূমিকা পালন করত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে এই গাছগুলোর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। তালগাছের উচ্চতা এবং আর্দ্রতা শোষণক্ষমতা বজ্রপাতকে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানোর আগেই নিরাপদে শোষণ করে নিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা উভয়ই বাড়িয়ে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের সংখ্যা ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকাগুলোতে ব্যাপক জলাভূমি থাকায় সেখানে বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে, যা বজ্রমেঘ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বজ্রপাত
- জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি