
বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক সংকট
একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে একটা বিতর্ক জারি আছে। জাতি হিসাবে আমরা কি বাঙালি, নাকি মুসলমান-এ প্রশ্নের মধ্যে ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ দুটি পরিচয়কে পৃথক ধরে নেওয়া হয়েছে এমনভাবে যেন একজন বাঙালির পক্ষে মুসলমান হওয়া বা একজন মুসলমানের পক্ষে বাঙালি হওয়া সম্ভব না। অথচ, বাস্তবে একজন ব্যক্তির পক্ষে একইসঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হওয়া সম্ভব। এ বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায় প্রত্যয় দুটোর সংজ্ঞা আর বাস্তব উদাহরণ দিয়ে।
বাঙালি বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীকে, যারা ভৌগোলিকভাবে বাংলা হিসাবে পরিচিত অঞ্চলে প্রজন্ম পরম্পরায় বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ খায়, এ সমাজে প্রচলিত নানা আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি অনুসরণ করে, ইত্যাদি। অন্যদিকে মুসলমান হলো ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়। পৃথিবীর যে কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের, যে কোনো ভাষাভাষী ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীই মুসলমান হতে পারে শুধু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির ভিত্তিতে। তার মানে, বাংলা অঞ্চলের বাংলাভাষী, বাঙালি সমাজের ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মুসলমান হতে বাস্তবে কোনো বাধা নেই। সত্যি বলতে, পৃথিবীর যে কোনো ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জন্যই তাদের দেশ, ভাষা, সামাজিক রীতিনীতির নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমান হতে বাস্তবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বেলায় এই প্রশ্ন বারবার সামনে চলে আসে যে, ‘আমি বাঙালি, না মুসলমান?’ জাতীয় পরিচয় নিয়ে এ সংকট যথাযথভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করাটা চব্বিশের জুলাই-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ।
বাংলা অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় নিয়ে এ সংকটের প্রথম প্রকাশ দেখা যায় এখন থেকে ঠিক ১৪৪ বছর আগে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার পরিচালিত সর্বপ্রথম ১৮৭১ সালের আদমশুমারিতে বাংলার পল্লি অঞ্চলে-সুনির্দিষ্ট করে বললে, পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষকসমাজের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি শিক্ষিত সমাজ এ আবিষ্কারে অবাক হয়। কারণ, তারা বিশ্বাস করত যে, বাংলা অঞ্চল হিন্দু জনগোষ্ঠীর আবাস এবং হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু। সেই থেকে বাঙালি জাতির পরিচয় ও ইতিহাস নিয়ে এক সুদীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের সূচনা হয়।
আদমশুমারির দশ বছর পর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ (১৮৮১) শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, বাংলার এ সংখ্যাগুরু মুসলমান কৃষকসমাজ ‘স্বধর্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান হইয়াছে।’ আর তাদের সেই ‘স্বধর্ম’ ছিল হিন্দু ধর্ম। এই দাবির পক্ষে তিনি যুক্তি দেন, বাইরে থেকে শাসক হিসাবে আগত সামান্যসংখ্যক মুসলমানের পক্ষে বংশবিস্তার করে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে আদমশুমারি অনুযায়ী সমগ্র বাঙালি জাতির অর্ধেক যে মুসলমান হিসাবে পাওয়া গেল, এটা কীভাবে ঘটল? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বঙ্কিম তার পরবর্তী প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’তে বাংলার সব জনগোষ্ঠীকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসাবে বিভক্ত করেন-আর্য, অনার্য, অনানার্য ও মুসলমান। তিনি এ চারটির মধ্যে প্রথম তিনটি জাতিকে হিন্দু হিসাবে শনাক্ত করেন তাদের মধ্যে প্রবহমান আর্যরক্তের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে; চতুর্থটিকে তিনি মুসলমান হিসাবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে সেই চার নম্বর অংশটি মুসলমান হয়ে উঠল, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর তিনি দেননি। এমনকি তার উল্লিখিত নানা মাত্রায় আর্যরক্তের উত্তরাধিকারী তিনটি জনগোষ্ঠীই বা কখন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হিন্দু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, সেই আলোচনাও তিনি উপস্থাপন করেননি। তিনি অনুমান করে নিয়েছেন যে, হিন্দুরা আবহমানকাল ধরেই বাংলার অধিবাসী। অর্থাৎ, বঙ্কিমচন্দ্র তার আলোচনার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা উপস্থাপন করেননি-এক. বাংলার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী মুসলমান হয়েছে কীভাবে? দুই. বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে?
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয় পরিচয়পত্র
- সংকট
- বাঙালি
- মুসলিম
- সাংস্কৃতিক