২৮ মার্চ ২০২৫। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২০। মিয়ানমারসহ আশপাশের দেশগুলো কেঁপে ওঠে মিয়ানমারের মান্দালয়ের জাগাইং শহরে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হন এবং অসংখ্য স্থাপনা ধসে পড়ে।
ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েন। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর মান্দালয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ১ হাজার কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ডে কম্পন অনুভূত হয়, ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ৩০ তলা নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়া নিয়ে।
ভূমিকম্পের উৎস, ক্ষয়ক্ষতি কোথায়, কেন হলো এবং এতে বাংলাদেশের জন্য কী কী শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, তা নিয়ে এই প্রবন্ধ।
ভূমিকম্পটির উৎস, মাত্রা এবং বৈশিষ্ট্য
ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল মান্দালয়ের জাগাইং হলেও এটি মান্দালয় থেকে টাউঙ্গু পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি স্লিপ ফল্ট লাইনের দুই পাশে দুই প্লেটের নড়াচড়ার কারণে সংঘটিত হয়েছে। পৃথিবীর ওপরের স্তরটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত, যাকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট, যেগুলো সবই ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। কিছু একে অপরের পাশাপাশি নড়াচড়া করে, আবার কিছু একে অপরের ওপরে বা নিচে পরস্পরের দিকে সরতে চায়। এই গতিবিধিই ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করে।
মিয়ানমারকে বিশ্বের ভূতাত্ত্বিকভাবে ‘সক্রিয়’ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটি চারটি টেকটোনিক প্লেট—ইউরেশিয়ান প্লেট, ভারতীয় প্লেট, সুন্দা প্লেট এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেটের অভিসরণস্থলের ওপরে অবস্থিত। ৪০-৫০ মিলিয়ন বছর আগে ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছে। বার্মা মাইক্রোপ্লেটের নিচে ভারতীয় প্লেট সরে যাওয়ার ফলে ২০০৪ সালে সুনামি সৃষ্টি হয়েছিল।
জাগাইং ফল্ট নামে একটি বড় ফল্ট রয়েছে, যা মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত এবং ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ। শুক্রবারের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ ছিল ‘স্ট্রাইক-স্লিপ’, যেখানে দুটি প্লেট একে অপরের সঙ্গে সমান্তরালে এবং অনুভূমিকভাবে কিন্তু বিপরীত দিকে সরে যায়। প্লেটগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে সরে যাওয়ার সময় ঘর্ষণশক্তির কারণে আটকে যায়। ঘর্ষণশক্তির সীমা যখন অতিক্রম করে যায় তখন হঠাৎ ছেড়ে দেয় এবং প্লেট দুটি হঠাৎ সরে যায়, যার ফলে ভূমিকম্প হয়।
ভূমিকম্প এত দূরে কেন অনুভূত হয়েছিল
ভূপৃষ্ঠের ৭০০ কিলোমিটার নিচ পর্যন্ত ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে। মান্দালয়ে ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার নিচে ছিল, এ রকম অগভীর ভূমিকম্পে ভূপৃষ্ঠে কম্পনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। ভূমিকম্পটিও বড় ছিল—রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার। পরাঘাত ছিল ১২ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, প্রধান কম্পনটি ছিল হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ২০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ ফল্ট লাইন বরাবর এই ভূমিকম্প হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অধিক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এই ফল্ট লাইনটি দক্ষিণে মাটির নিচে থাইল্যান্ডের দিকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত, যার কারণে মিয়ানমারের পরে থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে।
ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্প কত মাত্রায় আঘাত করবে, তা মাটির ধরনেও নির্ধারিত হয়। ব্যাংককের মাটি নরম কাদা যেখানে ভূমিকম্পের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় অ্যামপ্লিফিকেশন বলে। তাই ব্যাংককের ভূতত্ত্বগত গঠন ভূমিকম্পের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
সারমর্ম হলো, ফল্ট লাইনের বিস্তৃতি এবং নরম কাদামাটির স্তরের কারণে দূরে হওয়ার পরও থাইল্যান্ডে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাংকক থেকে কাছে হলেও প্লেটের সরণের দিকের সঙ্গে বাংলাদেশের দিক ছিল ৯০ ডিগ্রি। যার কারণে কম্পন অনুভূত হলেও মাত্রা কম ছিল বাংলাদেশে।