বছরের পর বছর বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহ ও সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইতিহাসে একই ধারা বারবার ফিরে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র হলো কর্মপ্রবণতার প্রতীক। তারা চট করে সাহসী পদক্ষেপ নেয় এবং তা নেয় অনেক সময় না ভেবেই। ভালো হোক বা খারাপ হোক—না ভেবেই তারা কাজ করে বসে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হলো এমন এক দেশ, যারা আগে কাজ করে, পরে চিন্তা করে। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শুল্কযুদ্ধ পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে চাল দেয়, তারপর হিসাব মেলায়।
এর বিপরীতে ভারত আইডিয়ায় সমৃদ্ধ, কিন্তু সিদ্ধান্তের আগে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ ও বিতর্কে আটকে যায়। ফলে পদক্ষেপ নিতে তাদের দেরি হয়ে যায়। অনেক সময় আদৌ কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। স্মার্ট সিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া—এসব প্রকল্প জাঁকজমকপূর্ণ ঘোষণার পর শিগগিরই আমলাতান্ত্রিক জটের নিচে চাপা পড়ে যায়।
অন্যদিকে চীন দশকের পরিকল্পনায় চলে। তারা ধীরে ধীরে কৌশলে গড়ে তোলে। আর একবার যখন তারা এগোয়, তখন তা পুরো পৃথিবীকে হতবাক করে দেয়। যেমন শেনজেনকে প্রযুক্তির কেন্দ্র বানানো বা ‘ডিপসিক’ নামের এক এআই অ্যাপ বানানো, যা ওয়াল স্ট্রিটকে নাড়িয়ে দেয় এবং এক রাতেই মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও করে দেয়।
এই পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধারাবাহিকতা, এক গভীর সত্য। কে কীভাবে বিশ্বকে দেখে এবং তাদের অবস্থান নেয়, তা এই পার্থক্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়।
আমেরিকা সাহসী পদক্ষেপ নিতে পরিচিত। কিন্তু তারা কখনো জিজ্ঞেস করে না, ‘এর মূল্য কত পড়বে?’ ভারতের আছে অসাধারণ সম্ভাবনা ও মেধা, কিন্তু ভেতরের ধীরগতি সবকিছু আটকে দেয়। চীনের চিন্তা ও কাজের মধ্যে যে ভারসাম্য, সেটাই তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে।
বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যে শক্তির মাপকাঠি কেবল সামরিক ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে নয়। এটি চাপের মুখেও নিজের অবস্থানে অটল থাকার সাহসের ওপর নির্ভর করে।
ভারত ২০০৮ সালে এই সাহসিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। সে বছর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। দুর্বল একটি জোট সরকার পরিচালনা করার পরও মনমোহন সিং আন্তর্জাতিক চাপে মাথা নত করেননি। বিশ্বজুড়ে ভারতের ওপর চাপ ছিল, যেন তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। কিন্তু সিং এ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই ভারতের পরমাণু স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রেখে এনএসজি (নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ) থেকে একটি ঐতিহাসিক ছাড় আদায় করেন।
প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মনমোহন এ চুক্তিকে ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করান। এর জন্য তাঁকে একবার অনাস্থা প্রস্তাব পর্যন্ত মোকাবিলা করতে হয়। সেই সময় তিনি একদিকে পার্লামেন্টের সমর্থন নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের পক্ষে একটি বড় কূটনৈতিক জয় অর্জন করেন। এতে এনপিটিতে স্বাক্ষর না করেও পারমাণবিক প্রযুক্তি গ্রহণের দরজা খুলে যায় ভারতের জন্য। এই চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের পর ভারতের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক বিচ্ছিন্নতা শেষ হয় এবং বিশ্ব মঞ্চে ভারতের কৌশলগত স্পষ্টতা, রাজনৈতিক সাহস এবং দৃঢ় কূটনীতির পরিচয় মেলে।
বর্তমানে রাশিয়া ও চীন দেখিয়েছে তাদের সাহসিকতা। যখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন মস্কো পিছু হটে না। বরং তারা নিজেদের অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজায় এবং বৈদেশিক নীতিও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে, যাতে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলা করতে পারে। চীনও ট্রাম্প সরকারের আমলে আগ্রাসী শুল্কনীতির মুখোমুখি হয়ে কড়া জবাব দেয়; অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় দিক থেকেই পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, যেন তারা বুঝিয়ে দিতে পারে যে ভয় দেখিয়ে তাদের কিছু করানো যাবে না।
অন্যদিকে ভারত একরকম নরম ও আত্মসমর্পণমূলক পথ বেছে নেয়। নিজের সার্বভৌম স্বার্থ জোরালোভাবে তুলে ধরার বদলে তারা যেন ওয়াশিংটনকে খুশি রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত। ২০০৮ সালের মতো দৃঢ় কৌশলগত অবস্থান আজ আর দেখা যাচ্ছে না।
ভারত যেন পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশাল জনসংখ্যা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সাহসিকতা প্রশ্নে তারা দ্বিধায় ভোগে। ভারত কি বিশ্বশক্তি থেকে ক্রমেই ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’-এ পরিণত হচ্ছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানাননি, যদিও মোদি বারবার তাঁকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে ফেব্রুয়ারিতে মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেটা ছিল খুব সাধারণ, ব্যবসাভিত্তিক একটি সফর। একটি কর্মসূচিতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল।