
উন্নয়নের অংশীদার চীন, নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দুটি দেশ একে অপরের পাশে থেকেছে, বন্ধুর মতো সহযোগিতা করেছে। এক সময়ের বৈরী সম্পর্ক আজ কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিশাল বিনিয়োগ উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, চীন কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হয়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে দেশের জন্য কী নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা জরুরি।
১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সাথে দেশটির আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এবং চীনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের শীতল সম্পর্কের কারণে পরিস্থিতি জটিল ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল, যা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। তবে, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে এবং চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়েছে। উভয় দেশই একে অপরের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরের স্বার্থের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ২০১৬ সালে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করে, যা সহযোগিতার একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেলিযোগাযোগ এবং শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে চীনা কোম্পানিগুলো বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চীনের এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য একাধিক সুবিধা বয়ে এনেছে—
প্রথমত, এটি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, যা বেকার সমস্যা সমাধানে সহায়ক।
তৃতীয়ত, চীনের উন্নত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের শিল্প খাতকে আধুনিকীকরণে সাহায্য করছে।
চতুর্থত, চীনের বিনিয়োগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে।
বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার ফলে অনেক চীনা কোম্পানি তাদের উৎপাদন কেন্দ্র চীনের বাইরে স্থানান্তরিত করতে আগ্রহী হচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অংশীদারিত্ব
- কূটনৈতিক সম্পর্ক