
শোডাউনের রাজনীতি নাকি অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন?
ছোটবেলার একটি স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভাসে। একটি স্কুল মাঠ, লাল-নীল পতাকায় সুসজ্জিত। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কী?’ মাঠের চারপাশে সারিবদ্ধ মানুষের ভিড়, পাশে হট্টগোল। হঠাৎ দেখলাম, কিছু মানুষ মারামারি শুরু করে দিল। একজন এমনকি চেয়ার তুলে আরেকজনকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। এই ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক দৃশ্য আমার শিশুমনে গভীরভাবে গেঁথে গেল। আর এর নাম শুনলাম আম্মার আতঙ্কিত মুখ থেকে— ‘ভোট’ ও ‘নির্বাচন’।
সময় অনেক পেরিয়ে এসেছি আমরা। গ্রামের ওই ভোটদানের পদ্ধতিতেও এসেছে নানা পরিবর্তন। একসময় ভোট মানেই গ্রামে বিড়ির বস্তা আর নির্বাচনি প্রচার অফিসে চব্বিশ ঘণ্টা গরম চা ও বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল অবধারিত। যাই হোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। কে নির্বাচনে অংশ নেবে, কারা কী দায়িত্ব পালন করবে, আদৌ নির্বাচন কবে হবে— এসব প্রশ্নে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাই মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এই অগ্রযাত্রায় কারা থাকবে, কারা থাকবে না, কাদের বাদ দিতে হবে— এ নিয়েই চলছে তর্ক-বিতর্ক। সম্প্রতি আমরা এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি ধাপ অতিক্রম করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ঘটনাবহুল সময়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে, আর আমাদের প্রিয় স্বদেশ গুজবের তীর্থভূমিতেও পরিণত হয়েছে।
আমরা ভবিষ্যতে কেমন দেশ দেখতে চাই? কী ধরনের ভোট চাই? কোন ধরনের সংস্কার প্রত্যাশা করি? সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? পুলিশ কবে আরও সক্রিয় হবে? কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য, শ্রমিকদের মজুরি-বোনাস, কৃষকদের সমস্যা, শিক্ষকদের বেতন, ভারত প্রশ্নে বিতর্ক ও সমালোচনা, বাণিজ্য পরিস্থিতি, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, মব ভায়োলেন্স, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, দখলদারিত্ব, তদবির বাণিজ্য, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম— এমন হাজারও ইস্যু আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে আমাদের প্রধান প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন কবে হবে এবং তার সুস্পষ্ট রোডম্যাপ কী হবে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসক এসেছে, আর ওই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইও হয়েছে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি স্বৈরাচারবিরোধী সফল সংগ্রাম হয়েছে। এর আগে আমরা ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন দেখেছি, যা ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। কিন্তু ২০২৪ সালের সংগ্রাম আরও গভীর। এই সময়কালে দেশে গণতন্ত্র ছিল না, বাকস্বাধীনতা ছিল না। গণতন্ত্রের নামে ভোটাধিকার হরণ, রাতে ভোট ডাকাতি, ক্রসফায়ার, হত্যা-খুন, সীমাহীন লুটপাট, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্মম দমন-পীড়ন, পরিবারতন্ত্র— এসবের মাধ্যমে দেশকে একটি স্থবির অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এসবই পূর্ববর্তী সরকার করেছে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকার ফল হিসেবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের করুণ পতন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
বিগত সরকারের দিকে তাকালে দেখি, পরপর তিনটি বিনা ভোটের নির্বাচন ও ‘খালি মাঠে’ ভোট উৎসবের মাধ্যমে তারা নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখেছিল। সংবিধান ও গণতন্ত্রের সকল বিধান লঙ্ঘন করে তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগটুকুও দেয়নি। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসনকে তারা ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার বানিয়েছিল। বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার, হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দিয়ে বিরোধীদের দমন করে দেশকে তারা একটি জেলখানায় পরিণত করেছিল।
বিগত সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় কাঠামোগত পরিবর্তন দেখালেও তাতে জনগণের জীবনমানে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। মেগাপ্রকল্প ও ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বলি দেওয়া হয়েছে বরং। বিগত আওয়ামী রেজিমে দলীয় দুর্বৃত্তায়নের যে শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, তা সব যুগকে হার মানিয়েছে। গ্রাম, মহল্লা থেকে শহর— সর্বত্রই লুটপাটতন্ত্রের একটি শক্ত কাঠামো তৈরি করেছিল তারা। এর ফলে একটি ভয়াবহ লুটপাটের অর্থনীতি গড়ে ওঠে, যার বড় ভাগীদার ছিল ক্ষমতাসীন শেখ পরিবারের বিভিন্ন সদস্য। গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। দলীয় পদ থেকে নির্বাচনের টিকেট বিক্রি পর্যন্ত— সর্বত্রই ছিল পরিবারটির একচ্ছত্র আধিপত্য।
আজ বাংলাদেশ যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য দায়ী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী মনোভাব। আমাদের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা— সবকিছুকেই তারা ধ্বংস করেছে নানামুখী তৎপরতায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহ ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শোডাউন
- রাজনৈতিক ভাবনা
- সারজিস আলম