
ডেমোক্রেসির পরিবর্তে মবোক্রেসি প্রাধান্য পেয়েছে
ড. জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। জাপানের হিরোশিমা ইউনিভার্সিটি থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনসহ নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. জোবাইদা নাসরীন: একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমি বলছি না। একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরে একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সাত মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে সেটার দোহাই দিয়ে আমরা এখনো অনেক কিছুকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার কাছে মনে হয়, সেটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কোনো সহিংসতাকে কোনো কারণ দিয়ে বৈধতা দেওয়া যাবে না। সেটা যদি দিই, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন নারীকে ধর্ষণ করা হয় তাদের পোশাক, হাঁটাচলা অন্যকে প্রভাবিত করে—সেই বক্তব্যকে ন্যায্যতা দিয়ে; আবার কেউ আওয়ামী লীগ করেছেন বলে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে হবে, মবের মাধ্যমে তাঁদের হেনস্তা করা যাবে কিংবা তাঁদের হত্যার হুমকি এবং নিপীড়ন করা যাবে।
এগুলোকে বৈধতা দেওয়া মানে হলো, জাস্টিসের ব্যাপারটাকে বন্ধ করে দেওয়া। আমরা যখন দেশের সাম্প্রতিক যেকোনো ঘটনাকে বিশ্লেষণ করি, তখন অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তারা এসব নিয়ে একধরনের বৈধতার সম্মতি উৎপাদন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আক্রান্ত হয়েছেন। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সময় এ-ও অভিযোগ করা হয়েছিল—এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার বলা হয়েছে, এ দেশের হিন্দুরা তো সংখ্যালঘু হিসেবে নির্যাতিত হয়নি, তারা নির্যাতিত হয়েছে আওয়ামী লীগ করার কারণে। আবার তারা ভারতের সঙ্গে যুক্ত বলে আমরা তাদের কল্পিতভাবে অভিযুক্ত করছি। এ ধরনের ন্যারেটিভ সমাজের মধ্যে প্রচলিত আছে। এভাবে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এগুলো যে আবার একটা জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে, ব্যাপারটা সে রকমও নয়। এসব ঘটনার পরের প্রতিক্রিয়া তাদের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার পেতেও সমস্যার সৃষ্টি করছে।
আরও একটু বিস্তারিত বলবেন?
ড. জোবাইদা নাসরীন: গণ-অভ্যুত্থানের পরিসর তৈরি হয়েছিল এবং আন্দোলনটা সংগঠিত হয়েছিল অবশ্যই একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার দলীয়ভাবে সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল নিয়োগ থেকে সবকিছুতে। বিশেষ করে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্রসংগঠন গণরুম থেকে শুরু করে সবকিছুতে একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। সেসব জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এসব ঘটনার প্রতিফলনে গণ-অভ্যুত্থানটা সংঘটিত হয়েছিল। তাহলে এরপর কী ঘটছে? এই আন্দোলনটাকে যতভাবে পারা যায় গ্লোরিফাই করা হচ্ছে। যেমন প্রথম দিকে বলা হয়েছিল এ আন্দোলনটা শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক ও জনতার আন্দোলন ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটাকে নিয়ে, এর মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো। বিএনপি বলছে তারা এর মাস্টারমাইন্ড, প্রধান উপদেষ্টা দেশের বাইরে একটা অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলমকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর জামায়াত বলল তারা এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড।
জুলাই আন্দোলনের মালিকানা কীভাবে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে, সেটা আমরা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দেখতে পেলাম। আন্দোলনটাকে মালিকানার ঘেরাটোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ফলে মবোক্রেসিকে উৎসাহিত করা হলো।
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. জোবাইদা নাসরীন: মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ নিশানা করে রাজনীতি করে দেশের মধ্যে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল এবং জনগণকে সেই মালিকানার অংশীদার করেনি। এ সরকারও একইভাবে জুলাই আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে সীমাবদ্ধ করেছে। আন্দোলনে যাঁরা শহীদ এবং আহত হয়েছেন, তার বেশির ভাগই গরিব ঘরের সন্তান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে আলাপ, এই আন্দোলনের আলোচনা থেকে ‘শ্রেণি’ প্রশ্নটাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা, ন্যায্যতা ও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘শ্রেণি’কে আমলে নিতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সময় আমরা কোনো শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব দেখিনি। আন্দোলনে এত আহত-নিহত হলেন, সেখানে তাঁদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই কেন? তাঁদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপেরও জায়গা রাখা হয়নি। এখন পর্যন্ত গার্মেন্টসে আন্দোলন চলছে। বেতনের আন্দোলন করার কারণে অনেক শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাই বলছি, এই আন্দোলনের ফল একটা গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শিক গোষ্ঠী সেটাকে প্রভাবিত করছে। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শিক গোষ্ঠী আন্দোলনকে ওন করার কারণে সরকারের সঙ্গে তারা আঁতাত করেছে এবং সরকার তাদের সাপোর্টও দিচ্ছে। ফলে এখানে ডেমোক্রেসির পরিবর্তে মবোক্রেসি প্রাধান্য পেয়েছে। সরকার এখনো মবের কাছে নির্ভর করছে। সরকার মবকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কীভাবে বলতে পারেন, আন্দোলনকারীদের উঠিয়ে দিতে জনগণই যথেষ্ট?
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণতন্ত্র রক্ষা
- মব জাস্টিস