
নতুন দল গণজাগরণের নয়া অধ্যায় রচনা করুক
ছাত্র-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভে যাদের জন্ম, তাদের কাছে রাজনীতিগতভাবে নির্যাতিত কিংবা শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রত্যাশাটা একটু বেশি থাকাই স্বাভাবিক। গণ-আন্দোলন কিংবা বৃহত্তর অর্থে গণ-অভ্যুত্থানের আপসহীন প্রক্রিয়ায়, চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিকভাবে যাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে; দুর্নীতি, অনাচার কিংবা অপশাসন-শোষণ তাদের এখনো স্পর্শ করেনি। ক্ষমতার লোভ কিংবা কায়েমি স্বার্থ ও অর্থ-বিত্তের পঙ্কিল দুর্বিপাকে আগে কখনো জড়িত ছিল না এই নবাগত নিঃস্বার্থ তরুণরা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনা কিংবা প্রথাগত ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আগে তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে জড়িত ছিল না।
ছাত্র-জনতার ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে তারা সংগ্রাম করেছে। অন্যায়, অবিচার ও অপশাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে। সেই ধরনের তরুণ ছাত্র-জনতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, যা এ দেশে আগে কখনো ঘটেনি। জাতীয় পর্যায়ে তরুণ ছাত্র-জনতার কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হয়নি।
সেই অর্থে এই উপমহাদেশ কিংবা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি চমকপ্রদ ঘটনা। এর যেমন রাজনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক দিক থেকে একটি বিশেষ তাৎপর্য বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে প্রচুর।
গাজীউল হাসান খানস্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থাৎ বিগত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে এ দেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ নিজেরা স্বাধীনভাবে কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াস পায়নি। কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে তারা কাজ করেছে।
অনেকটা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করেছে ছাত্রসমাজ এবং তার ফল ভোগ করেছেন মূল দলের নেতারা। এতে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ তাদের নীতি-আদর্শ ভুলে নেহাত রাজনৈতিক তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের কোনো আন্দোলনের ফসল জনগণের গোলায় ওঠেনি। এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই কায়েমি স্বার্থের কাছে দিনে দিনে অপাঙক্তেয় হয়ে উঠেছে।
শুধু তা-ই নয়, ক্রমে ক্রমে ছাত্রদের অনেকে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মতো শুধু অস্ত্রধারী দুর্নীতিবাজ নয়, লোমহর্ষক ঘাতকে পরিণত হয়েছে। অনেকে আবার ছাত্ররাজনীতিকে অর্থ-প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে পেশাগতভাবে গ্রহণ করেছে। সেই বিবেচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল গঠন অবশ্যই আমাদের চেতনার মূলে আঘাত হেনেছে। এতে আর যা-ই হোক, দেশের চিন্তাশীল মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি একটি দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত।
বিশ্বের যেকোনো জাতির জন্য তার ছাত্রসমাজ তাদের আগামী দিনের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আজকের তরুণরাই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আমাদের এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অর্থাৎ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর ৭৮ বছর ধরে আমাদের ছাত্রসমাজ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। কখনো নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে, আবার পাকিস্তানি শাসকদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য এবং অন্যায় শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েও তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম গড়ে তোলাও ছিল আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিংবা বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অধ্যায়। এসব বলার মধ্য দিয়ে আমি একটি কথাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই যে এ দেশে এমন কিছুই ঘটেনি বা কোনো আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি, যার মূল নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ অনুপস্থিত ছিল। বরং তারাই ছিল এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সার্বিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মূল বা প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই অতীতে তাদের রাজনৈতিক দল গঠন করার মতো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তারা সব সময়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। বড় বড় রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়ই নিজেদের পরিচিতি সীমাবদ্ধ রেখেছে। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণেই ক্রমে ক্রমে আবার ছাত্রদের মধ্যে কৌশলগত পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিগত দেড় দশকের অধিক সময়ব্যাপী আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী কিংবা আধিপত্যবাদী তাণ্ডবে যখন দেশের মূলধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একরকম অচল বা স্থবির হয়ে পড়েছিল, নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছিল তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড, তখনই এক নতুন রণকৌশলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে সম্মুখসমরে নেমে আসে নতুন প্রজন্মের একদল তরুণ ছাত্র-ছাত্রী। তারা মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে সরকারি ঘাতক বাহিনী এবং শাসকদলের অনুসারী ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী গুণ্ডাদের মুখোমুখি হয়ে রুখে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত তাদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ছয় দফা থেকে এক দফায় নেমে আসে। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণসহ সমগ্র বিশ্ব তখন অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করছিল ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শেষ পরিণতি দেখার জন্য।
একটি জাতির সবচেয়ে নির্ভীক ও অগ্রসর অংশ তাদের দেশে আপাদমস্তক পরিবর্তন আনতে চায়, অথচ তারা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে না—এটি তো মোটেও কাম্য নয়। এটি হতে পারে না। তাহলে ছাত্র-জনতার এত রক্তদান, এত আত্মত্যাগ—সবই তো বিফলে যাবে। সে কারণেই বিশ্বের একজন অন্যতম প্রধান দার্শনিক এবং শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিষয়ক গবেষক প্লেটো তাঁর রচিত ‘দ্য রিপাবলিক’-এ বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে এসে শাসন পরিচালনা করতে অস্বীকার করার বড় শাস্তি হলো নিজের কাছেই খাটো বা অপাঙক্তেয় হয়ে যাওয়া।’ প্রাচীন গ্রিসে অর্থাৎ প্লেটোর সমসাময়িককালে নগর রাষ্ট্র এথেন্সের তরুণ ছাত্র-জনতার রাজনীতিচর্চা সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল না হলেও এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্লেটো সমাজের তরুণ অগ্রসর অংশকে লক্ষ্য করেই তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার উক্তিটি করেছিলেন। কারণ একনিঃশ্বাসে রাষ্ট্রের বা সমাজের দুর্নীতি ও জরাগ্রস্ত সব কিছু বদলে দেওয়ার মানসিকতা, সৎসাহস ও যোগ্যতা একমাত্র তরুণদের মধ্যেই রয়েছে। সে হিসেবে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান কুশীলব বা আরেক অর্থে দিকনির্দেশক নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও অন্য তরুণদের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল গঠন করাকে অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এবং বলেছেন, অন্য দুই সহযোদ্ধা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদেরও অবিলম্বে নতুন দল সংগঠিত করার কাজ পূর্ণোদ্যমে শুরু করা উচিত। এ দলের সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের গভীর বিশ্বাস যে তরুণ ছাত্রনেতারা দুই মাসের অব্যাহত গণ-আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে এবং উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী অপশাসন—তাদের পক্ষে রাষ্ট্র কিংবা শাসনভার পরিচালনা ব্যর্থ হতে পারে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের জরুরি মেরামত কিংবা সার্বিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা তরুণ বিএনপি নেতা তারেক রহমানও বলেছেন। তারেক রহমান প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। অন্যরা এতটা গুরুত্বের সঙ্গে প্রস্তাবিত সংস্কারের পক্ষপাতী নয়। তারা চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সরে পড়ুক। তারা ক্ষমতায় এসে যদি সংস্কারের প্রয়োজন মনে করে, তাহলে সেগুলো করবে। সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ব্যাংকিং খাতে জরুরি সংস্কারসহ বিগত বহু দশকেও কোনো জরুরি সংস্কার সাধিত হয়নি। ফলে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে বেড়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি, দুঃশাসনসহ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ অনাচার। তত দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় দলের নেতারা আরো বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছেন, কিন্তু কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। সে কারণে দেশের অনেক চিন্তাশীল মানুষ বলে থাকেন, ‘এই বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের দিয়ে আর বিশেষ কিছু হবে না। এখন প্রয়োজন তরুণ নেতৃত্ব, যাদের কোনো পিছুটান নেই, আছে পরিবর্তনের এক দুর্দমনীয় স্পৃহা ও মানসিকতা।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনীতিতে নতুন দল