
তাহলে নির্বাচন কবে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন 'আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে' কিংবা 'সম্ভবত হবে'র মধ্যে আটকে আছে, তখন শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে কথা না বলতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম।
তার ভাষায়, 'যতদিন আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে না দেখছি, এই বাংলাদেশে কেউ যেন ভুলক্রমেও ওই নির্বাচনের কথা না বলে।'
প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনাকে কি আদৌ ফাঁসির মঞ্চে আনা সম্ভব হবে? তিনি নিজে ফাঁসির মঞ্চে ঝোলার জন্য দেশে আসবেন বা ভারত তাকে ফেরত পাঠাবে—এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে? কিংবা সরকার ভারতের ওপর এমন চাপ তৈরি করতে পারবে, যে কারণে তারা হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য হবে? এর সম্ভাবনা কতটুকু?
যদি সম্ভব না হয় এবং হাসিনাকে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে আদালত ফাঁসির রায়ও দেন, তারপরও ওই ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হবে? যদি সম্ভব না হয় তাহলে দেশে নির্বাচন হবে না? আর দেশে নির্বাচন কবে হবে কিংবা কারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলবেন বা বলবেন না—সেটি কি জাতীয় নাগরিক পার্টি ঠিক করে দেবে?
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল—বিশেষ করে বিএনপি—দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে। বিএনপি কি তাহলে এখন নির্বাচন নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেবে?
মনে রাখতে হবে, এখন দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে না এবং সারজিস আলমরাও এখন আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নন। তারা এখন দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই একটি দলের নেতা। ফলে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষ যেভাবে বিবেচনা করে, তাদেরকেও এখন থেকে সেভাবেই বিবেচনা করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এই সংগঠনের নেতা হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে জনপরিসরে তাদের যে অবস্থান ছিল, সেটি এখন নেই। সুতরাং তারা যদি এমন কোনো টোনে কথা বলেন, যাতে মনে হয় যে তারা সরকারের অংশ; সরকারের কোনো আচরণে যদি মনে হয়, এই দলের প্রতি তাদের বিশেষ নজর বা আশীর্বাদ রয়েছে, তাহলে দলের আত্মপ্রকাশের আগে থেকেই তাদের ওপর যে 'কিংস পার্টি'র তকমা লেগেছে—সেটিই সত্য প্রমাণিত হবে। তারা যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়ে যাবেন বলেও ধারণা করা যাচ্ছে, ফলে তাদের উচিত হবে নির্বাচন ইস্যুতে এমন কোনো কথা না বলা বা এমন কোনো অবস্থান গ্রহণ না করা, যা অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেলেও জনজীবনে এখনো স্বস্তি ফেরেনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও ঠিকমতো কার্যকর নয়; রাষ্ট্রের বাহিনীগুলো কতটা সক্রিয় ও কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে—তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ফলে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং এমন কোনো কথা বলা বা কাজ করা উচিত হবে না, যা ঐক্যের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়।
এটা মানতে হবে, যদি গত সাত মাসে জনমনে স্বস্তি বিরাজ করতো; অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক হতো; চাঁদাবাজি দখলবাজি বন্ধ হতো; সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতো বা লক্ষ্মণ দেখা যেতো; কিছু কট্টরপন্থী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতো; এই সরকারের ওপর দলমত নির্বিশেষে সবাই আস্থা রাখতো; বিভিন্ন ঘটনায় যদি মানুষের মনে এই ধারণা তৈরি না হতো যে এসব অপরাধ সরকার চাইলেই থামাতে পারত, কিন্তু যে কারণেই হোক থামায়নি অথবা এইসব ঘটনার পেছনে সরকারের সমর্থন ও ইন্ধন রয়েছে—তাহলে নির্বাচনের দাবিটি জোরালো হতো না। তখন কোনো রাজনৈতিক দল দ্রুত ভোটের ব্যাপারে চাপ দিলেও তারা সাধারণ মানুষের সমর্থন পেত না।
কিন্তু গত সাত মাসে সরকারের দক্ষতা নিয়ে জনমনে দারুণ সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে। তাদের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার হয়তো ঘাটতি নেই; তারা যেরকম ধ্বংসস্তূপের ভেতরে দায়িত্ব নিয়েছে, তাতে সবকিছু রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে—এমনটি প্রত্যাশা করাও যেহেতু যৌক্তিক নয়, কিন্তু তারপরও এই সরকারের দক্ষতা নানাভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।