
মানবসভ্যতার অপরিকল্পিত উন্নয়নে পথহারা প্রকৃতি
মানবসভ্যতায় আগুনের আবিষ্কার যেমন প্রযুক্তির উন্নয়নে এক বিশাল মাইলফলক তেমনি পরিবেশের পরিবর্তনেও বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় পরিবেশে যে নেতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা লম্বা সময় ধরে পরিবেশ দূষণ এবং গত শতক থেকে দ্রুত উন্নয়নের নামে পরিবেশের ওপর জুলুমের ফল। প্রযুক্তির উন্নয়ন নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসকে অনেক আরামপ্রদ করেছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবেশের দূষণকে তীব্রতর করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনো মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।
প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার বছর আগে মানুষ শিখেছিল কীভাবে আগুন ব্যবহার করতে হয়। মূলত বন্যপ্রাণীর আক্রমণ এবং ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার কাজে প্রথম দিকে আগুনের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। ধারণা করা হয়, মানুষ যখন প্রথম পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মাধ্যমে আগুন জ্বালাল তখন যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হলো সেটাই ছিল মানবসৃষ্ট প্রথম বায়ুদূষণ। অর্থাৎ এখান থেকেই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংযোজন হতে থাকে এবং ক্রমে তা বাড়তে থাকলে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া প্রায় ১১ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানুষের মাধ্যমে বনে আগুন লেগেছিল এমন প্রমাণ মিলেছে কাঠের পোড়া কয়লা, জ্বালানি কাঠের পোড়া রেণুর অস্তিত্ব থেকে। এ সময় থেকেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বাঁচার পরিবর্তে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেঁচে থাকার কৌশল পরিবর্তন শুরু করে।
বলা চলে ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করার জন্য মানুষ কাদা-মাটি, বন পরিষ্কার করে ভূমির পরিবর্তন করে এবং এভাবে প্রকৃতি বিনাশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বসতি স্থাপনের পর মানুষ ভেড়া, ছাগল, কুকুরসহ নানা প্রাণী পোষ মানাতে এবং পালন করা শুরু করে। মানুষের মধ্যে গৃহে প্রাণী পোষ মানানো এবং লালন-পালনের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন এবং সম্পদ বৃদ্ধির চিন্তা বিস্তার লাভ করে। প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে ব্যবহারের সাফল্য সভ্যতার উন্নয়নে মানুষকে আরো উদ্বুদ্ধ করে, যা পরে তাদের নগরজীবন গড়ার পথ দেখায়। এভাবে নাগরিক সভ্যতার উদ্ভব হলে যেমন নগরের বিস্তার হতে থাকে তেমনি বিস্তার হতে থাকে শহুরে জীবনের।
মেসোপটেমীয় সভ্যতা যেটি বর্তমানে ইরাক একসময় ছিল পলল সমভূমি। মূলত মেসোপটেমীয় সভ্যতাকে প্রথম নগর সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এখানকার ঘন বনভূমি পরিষ্কার করে ব্যাবিলন শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেসোপটেমিয়ান অধিবাসীরা খাল কেটে প্রথম সেখানে সঠিকভাবে পানি সেচের ব্যবস্থা শুরু করে বলে ধারণা করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো সেচ প্রক্রিয়া শুরু করলেও সঠিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় নদীর ভাঙন এবং গভীরতা কমে যাওয়ায় বন্যা ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্রমে এ সভ্যতার বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আধিপত্যবাদী রোমান সভ্যতার আধিপত্যের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে প্রকৃতির ওপর। রোমান সভ্যতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বনভূমি এবং বন্যপ্রাণী। রোমানরা বন্যপ্রাণীর নানামুখী ব্যবহার করত। রোমানরা সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে জলাভূমি ধ্বংস করেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রাণী উৎসর্গ এবং পশুর নানাবিধ ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল তাদের। বন্যপ্রাণী শিকারের পর এর চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পোশাক ও আসবাবপত্র তৈরি করত রোমানরা। এর বাইরে শিল্প খাতকে সমৃদ্ধ করতে, বিনোদন খাতের উন্নয়নেও তারা পশু এবং পশুর চামড়া ব্যবহার করত। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী তাদের হাতে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্ধিত চাহিদা মেটাতে রোমানরা ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি এশিয়ার থাইল্যান্ড থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ এবং পাখি আমদানি করত। রোমানদের এ প্রাণী সংগ্রহ আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, নীল নদের নিম্ন অববাহিকা, সিরিয়ার কিছু অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাণী শিকারকে বিস্তৃত করে, যার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে।
শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রীর ভারী ধাতুর ব্যবহার মূলত রোমান সভ্যতায় বিকশিত হয়। বিশেষ করে রোমানরা স্থাপত্য, জাহাজ নির্মাণ, স্টেশনারি তৈরিসহ নানা কাজে সিসার ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। রোমানদের অ্যালকোহলের প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল এবং এসব অ্যালকোহল সংরক্ষণের কাজে বিশেষ করে এর গাজনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সিসা ব্যবহার করা হতো। বলা হয়ে থাকে অ্যালকোহলের মাধ্যমে সিসা গ্রহণ করায় রোমানরা মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে থাকে এবং এ সভ্যতায় বিপর্যয় নেমে আসে। সিসার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর সংস্পর্শের কারণে রোমান সাম্রাজ্য এবং তখনকার অভিজাতদের মধ্যে ‘প্লাম্বিজম’ এবং ‘স্যাচুরিন গাউটে’ আক্রান্ত হওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে এবং এভাবে রোমান সভ্যতার সমাপ্তি ঘটে। প্রাচীনকাল থেকে সিসার ব্যবহার বাড়তে থাকায় রোম সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত এর পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন টনে পৌঁছায় বলে অনুমান করা হয়। রোমানদের দ্বারা ভারী ধাতু সিসা ব্যাপক ব্যবহারের কারণে সিসাকে ‘রোমান মেটাল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
প্রাক-শিল্প যুগে সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসও পরিবেশের পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। মানুষের এমন বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে সমুদ্রের মাছের ওপর এবং আকাশের পাখির ওপর এবং পৃথিবীতে চলাচলকারী সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর ওপর কর্তৃত্ব রয়েছে তাদের। এটিকে আধিপত্যের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছে মানুষ এবং এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে। তবে বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, তখন ব্রিটেনে দ্বিতীয় রিচার্ডের শাসনামলে বায়ূদূষণ রোধে প্রথম আইন প্রণয়ন হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানবসভ্যতা