আমাদের সুলতানারা স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে
সোয়া শ বছর আগে বেগম রোকেয়া তাঁর একটি স্বপ্নের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন সুলতানা’স ড্রিম গ্রন্থে। সুলতানা নামের আড়ালে বেগম রোকেয়া নারীস্থান নামের একটি দেশের গল্প বলেছেন, যেখানে দেশ চালায় নারী, ঘর সামলায় পুরুষ। সেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, কোনো দ্বন্দ্ব নেই। নারীরা সেখানে উড়ন্ত গাড়ি চালায়, সূর্যতাপে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
না, নারীস্থান নামের কোনো দেশ নেই। আজও অধিকাংশ নারী গৃহবন্দী। কিন্তু মুক্ত হওয়ার, সমতা অর্জনের যে স্বপ্ন বেগম রোকেয়া সোয়া শ বছর আগে দেখেছিলেন, তা এখনো দীপ্যমান। সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঁচজন মেয়ে দল বেঁধে হিমালয়ের চূড়াদেশ জয় করে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা গেঁথে রেখে এসেছে। এটিই শীতকালে হিমালয়ের দুর্গম লাংটাং শৃঙ্গে দলবদ্ধ নারী আরোহীদের প্রথম সফল অভিযান। এই পাঁচজন এক অসম্ভবকে সম্ভব করে জানিয়েছে, ‘বেগম রোকেয়ার শিক্ষা আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা হয় না। সুলতানার স্বপ্নই আমাকে হিমালয় অভিযানের প্রেরণা জুগিয়েছে।’ হিমালয় বিজয় শেষে কাঠমান্ডুতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচজনের পক্ষে এ কথা জানিয়েছে ইয়াসিম লিসা।
২০২৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকো সুলতানা’স ড্রিমকে ‘বিশ্বস্মৃতি নিবন্ধন’–এ (ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি রেজিস্ট্রার) অন্তর্ভুক্ত করে। সে সময় সংস্থাটি জানিয়েছিল, ১০০ বছর আগে লেখা হলেও যে নারীস্থান রোকেয়া কল্পনা করেছিলেন, তার অনেক কিছুই এখন বাস্তব। সৌরবিদ্যুৎ এখন ঘরে ঘরে। বিমানে চড়ে আমরা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে উড়ে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু যা এখনো বাস্তব নয় তা হলো, নারীর সমতা। বিশ্বে তেমন দেশের সংখ্যাই বেশি, যেখানে নারী নয়, ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষ। শুধু তা–ই নয়, পুরুষদের চেষ্টা যেভাবে সম্ভব মেয়েদের ঘরে আটকে রাখা। দুই হাজার বছর আগে এথেন্সের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রশাসনে নারীর কোনো ভূমিকা ছিল না। এই একুশ শতকে এসে নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের অধিকার সংকোচনের চেষ্টার শেষ নেই। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের চলতি রক্ষণশীল রিপাবলিকান নেতৃত্ব পারিবারিক মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে নারীর গর্ভপাতের অধিকার রদ করেছে। যুক্তি তুলে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, নারীদের স্থান বাইরে নয়, ঘরে। তাদের প্রধান কাজ সন্তান উপহার দেওয়া।
বস্তুত নারীর অধিকারের ব্যাপারে পৃথিবীর কমবেশি সব দেশেই অধিকাংশ পুরুষের এক যুক্তি, মেয়েদের স্থান ঘরে (অর্থাৎ হেঁশেলে)। যে পাঁচ বাঙালি মেয়ে হিমালয় জয় করলেন, তাঁদের একজনের নাম সুলতানা রেখা। রেখা বলেছেন, ‘আমরা হিমালয় জয়ে যাচ্ছি শুনে অনেকে বলেছে, পাহাড় জয় করে কী হবে! মেয়েদের এমন কাজ করতে হবে কেন?’
লক্ষ করুন, যে কথা জেডি ভ্যান্সের, সেই একই কথা বাংলাদেশের অসংখ্য পুরুষেরও। সম্প্রতি জয়পুরহাটে মেয়েদের দুটি ফুটবল দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, তা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ড! এক পক্ষের আপত্তি ও হট্টগোলের কারণে মেয়েদের খেলাটি পণ্ড হয়ে যায়। পরে চারদিকে আপত্তি উঠলে পুলিশি পাহারা বসিয়ে আবার খেলাটি আয়োজন করা হয়।
ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দু–একটি দেশ বাদ দিলে পৃথিবীর সব দেশেই ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষদের আধিপত্য। সবার এক যুক্তি, মেয়েদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে মহা অনাচার হবে। নীতিনিষ্ঠা সব গোল্লায় যাবে। অথচ বাস্তবে ছবিটা কিন্তু উল্টো। শিক্ষাক্ষেত্রে বলুন, রাজনীতি বা ব্যবসার কথা বলুন, মেয়েদের যখনই সুযোগ দেওয়া হয়েছে, পুরুষের চেয়ে অনেক ভালো ফল দেখিয়েছে তারা। সব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে মেয়েরা এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষায় এগিয়ে। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পাসের হারে ও জিপিএ–৫ পাওয়ায় এগিয়ে।