![](https://media.priyo.com/img/500x/https://images.ajkerpatrika.com/original_images/sea_oUsKipF.jpg)
জলবায়ু সংকটের বিপদ এখন সাগরেও
জল আর বায়ু—এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জলবায়ু শব্দটি। তেমনি আবহাওয়া শব্দটিও ‘আব’ ও ‘হাওয়া’ শব্দ দুটির সম্মিলনে সৃষ্টি। আব মানে পানি আর হাওয়া মানে বাতাস। তাই অর্থগতভাবে জলবায়ু ও আবহাওয়াকে একই রকম মনে হলেও বিজ্ঞানীরা এ দুটির মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। আবহাওয়া বলতে বোঝানো হয় কোনো নির্দিষ্ট স্থানের স্বল্প সময়ের বা এক দিনের বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা। আর জলবায়ু হলো কোনো বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদান যেমন—বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির ৩০ থেকে ৩৫ বছরের গড় অবস্থা। এ দুটি শব্দই বায়ুমণ্ডল তথা পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে থাকা পরিবেশের অবস্থাকে নির্দেশ করে। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের নিচেও যে আরেকটি পরিবেশ ও জগৎ রয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা খুব কম ভাবি, সে অবস্থা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিই বা সে পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিই।
সম্প্রতি গবেষকেরা ভূপৃষ্ঠের নিচের পরিবেশের বিভিন্ন বিপত্তি ও বিপর্যয়ের তথ্য জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে পৃথিবীর প্রায় চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে বিস্তৃত সাগরের অগাধ জলরাশির তাপমাত্রার পরিবর্তনে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর তারও যে বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, সে বিষয়টি গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে।সাগরের পানির তাপমাত্রা পূর্বের তুলনায় দ্রুতহারে বাড়ছে। এতে মেরুদেশে সাগরের ওপর ভেসে থাকা বিশাল বিশাল বরফখণ্ড তলা থেকে গলন শুরু হয়েছে এবং তা ভাসতে ভাসতে মেরুচ্যুত হয়ে অন্য দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। খবর হলো, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইসবার্গটি অ্যান্টার্কটিকা থেকে সরে যাচ্ছে এবং এই সরে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর জন্য এক নতুন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবীর বৃহত্তম হিমশৈল ‘এ ২৩ এ’ আইসবার্গটির আয়তন ৩৯০০ বর্গকিলোমিটার। ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল কাউন্টির সমান এই বরফখণ্ডের আয়তন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। উপগ্রহ চিত্রের ছবি বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে তার আয়তন প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। বরফখণ্ডটি এখন জর্জিয়া উপকূলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে জর্জিয়ায় পেঙ্গুইনসহ অনেক জীবের খাদ্য ও বাসস্থানের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রায় ৪০০ মিটার পুরু এই আইসবার্গ ১৯৮৬ সালে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে দ্রুতই সেটি যুক্ত হয় মহাসাগরের উপকূলে এবং সেখানেই প্রায় ৩০ বছর ধরে ওয়েডেল সাগরে স্থির ছিল। ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে বলেছে, ২০২০ সাল থেকে উত্তর দিকে তা সরতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সরতে সরতে একসময় সেটি অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়বে এবং সেখানে গেলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিমশৈলটি। এভাবে যদি অন্যরাও সরে আসে, তো সেটি হবে পৃথিবীর জন্য এক নতুন বিপদ। সাগরের বাস্তুতন্ত্রের জন্য আর এক বিপদ হলো সাগরদূষণ। প্লাস্টিকসহ নানা রকম বর্জ্য এখন সাগরে মিশছে এবং পানি দূষিত হয়ে সাগরের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে।
আরেক বিপদ হলো সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি। গবেষকদের তথ্যমতে, আশির দশক পর্যন্ত দশকপ্রতি সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক শূন্য ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা খুব বেশি ছিল না বলে আমাদের ভাবনারও তেমন বিষয় ছিল না। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে তাপমাত্রা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। সেখান থেকে প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে এই কয়েক দশকে সমুদ্রের পানি অনেকটা গরম হয়ে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে সাম্প্রতিক দশকে। বর্তমান দশকে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দশমিক ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৈশ্বিক উষ্ণায়নই যে এর জন্য দায়ী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অনেক জলজ জীবের আচার-আচরণ বদলে যাচ্ছে এবং প্রজননস্থলের সংকট তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দিন শেষে আমাদের কী ঘটবে বা আদৌ আমরা পরিত্রাণ পাব কি না, জানি না। তবে সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি না কমাতে পারলে তার জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। সাগরের পানি গরম হলে বরফ গলবে, আবার বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ার ফলেও বরফ গলবে। এতে সাগরের পানি বাড়বে, বাড়বে সাগরকূলবর্তী ভূমি তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি। এতে নিম্নভূমিতে বসবাসরত বিশ্বের প্রায় ৬৮০ মিলিয়ন (৬৮ কোটি) মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ বড় শহরের অবস্থান সাগরপারে। সেই সব শহরে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস করে (প্রায় ২০০ কোটি), তাদের আমিষের চাহিদা পূরণের সিংহভাগ আসে সাগরের মাছ ও প্রাণী থেকে। সাগরে মাছ ধরার জন্য রয়েছে ৬ কোটির বেশি মৎস্যজীবী। কাজেই সাগরের বিপদ মানে প্রকারান্তরে তা আমাদেরই বিপদ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জলবায়ু সঙ্কট