
সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ালেই কি নারীর ক্ষমতায়ন হবে
আমাদের দেশের নারীরা আর্থসামাজিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহের মতো সমস্যাগুলো নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই ধরনের সমস্যাগুলোর সমাধানে এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসনের প্রথা চালু করা হয়।
প্রথমে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ছিল ১৫, যা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়। তবে এই উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়ন বা তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে কতটা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে।
সংরক্ষিত আসন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, নারী সংসদ সদস্যরা নারীদের ক্ষমতায়ন ও নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। বাস্তবে দেখা যায়, অন্যান্য সংসদ সদস্যের মতো তাঁরাও মূলত দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী হয়ে যান। এর ফলে নারীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাঁদের ভূমিকা সীমিত থেকে যায়।
নির্বাচন সংস্কার কমিশন সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে। আগের মতো দলীয় মনোনয়নের পরিবর্তে এবার নারীদের ‘ঘূর্ণায়মান’পদ্ধতিতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসতে হবে।
আগে ধারণা করা হতো, অনির্বাচিত হওয়ায় নারী সংসদ সদস্যরা তাঁদের ভূমিকা পালনে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তবে নতুন এই ব্যবস্থা তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করবে এবং সংসদে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করবে বলে মনে করছে সংস্কার কমিশন।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়, তা হলো: যেখানে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো পুরোপুরি নারীবান্ধব নয়, সেখানে নারীদের জন্য নতুন ঘূর্ণমান নির্বাচনপদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে?
নারীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য নীতিগত পরিবর্তন একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতা নারীদের পথকে এখনো কঠিন করে রেখেছে।
নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে সীমিত। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নারীরা সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার মাত্র দুটি আসনে তাঁরা জয়ী হতে পেরেছিলেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১৫টি আসনে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২১টি আসন ছাড়া অন্য কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে নারীরা ‘ডাবল ডিজিট’সংখ্যক আসনে জয়ী হতে পারেননি।
এটি নির্দেশ করে যে নারীদের রাজনৈতিক সফলতা এখনো সীমিত এবং তা কেবল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরিবর্তন দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়।
২০১৮ সালের বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৭ জন নারী প্রার্থী ৬৮টি নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে মাত্র ২৩ জন বিজয়ী হন। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সংখ্যাটি এখনো অনেক সীমিত।
বর্তমান নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার আলোকে নারীদের জন্য ১০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে অন্তত ২০০ নারী প্রার্থীর প্রয়োজন হবে। যেহেতু এতসংখ্যক নারী প্রার্থী দেশের ইতিহাসে কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি, তাই এটি আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারীর ক্ষমতায়ন
- সংরক্ষিত নারী আসন