উত্তরবঙ্গ কৃষক সমাবেশ কেন দরকার ছিল
মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। স্থান-অঞ্চল ছাপিয়ে তা কদাচিৎ সব মানুষের গণ–অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে। তখন মানুষ নিজের জীবন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে। আশায় বুক বাঁধে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আশাবাদের ঢেউ জাতির মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে। কৃষকেরাও সেই আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু তাঁদের কথা বলবে কে? প্রান্ত থেকে তাঁদের দুর্দশার কথা কীভাবে পৌঁছাবে কেন্দ্রে? এই কথাগুলো দাবি করে তোলার জন্য গত ২৬ জানুয়ারি চিলমারীতে ছিল কৃষক মহাসমাবেশ। সেখানে অনেক কথা বলার ছিল সর্বার্থে প্রান্তে বাস করা এই মানুষগুলোর। সেসবের কিছু অগ্রগণ্য চাওয়া তুলে ধরা যাক।
হাট ও ঘাট থেকে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ
গত বছরের ঘটনা। ফিরছিলাম গরুর হাট হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ফটো মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটির লোকদের সঙ্গে কথা বলি। গরুর পাইকার উলিপুর ধামশ্রেণির ব্যাপারী আবুল কাশেম (৬৫) ও উলিপুর সদরের আমিনুল(৫০)। তাঁরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছ থেকে খাজনা নিয়েছেন ৩০০ টাকা এবং তাঁদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা।
পরে রসিদের ছবি ফেসবুকে দিলে পোস্টে কড়াই বরিশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদাকাত হোসেন (৪৫) জানান, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর হাট জোড়গাছের এখন সুনামের পরিবর্তে দুর্নামে ভরপুর।’ হাসান আল নাহিদ লিখেছেন, ‘এরা সংখ্যায় বেশি, যা জুলুম করে তা-ই মানতে বাধ্য হয়।’
চিলমারী বন্দর থেকে রৌমারী। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। সোয়া ঘণ্টার পথ। একই শক্তির শ্যালো ইঞ্জিন একটি ভটভটি একই সময়ে চিলমারী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম শহরে যায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। তাহলে ১০ গুণ যাত্রী নিয়ে নৌকা চললে ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। সেখানে ১০০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি ৯৫ টাকা নৌযাত্রীরা কেন দেবেন?
পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষকেরা যে হাটে কৃষিপণ্য কেনাবেচা করেন, সেটা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন ছিল। জমিদারের হাটের খাজনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা নিজেরা হাট বসিয়েছেন। নৌপথে খাজনার অত্যাচারে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঘটনা আছে। হাট ও ঘাট থেকে ইজারার নামে জমিদারি প্রথাটি রয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের চেয়ে নৌপথে তেল-মবিল খরচ কম লাগলেও সড়কপথের চেয়ে নৌপথে ভাড়া দু–তিন গুণ গুনতে হয়।
কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ
ব্রহ্মপুত্রের শাখাহাতী চরের মিলন মিয়া (৪০) তিনি নিয়ে এসেছেন ১০ মণ কাঁচা বাদাম। প্রতি মণ তিন হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা থাকলেও তা দুই হাজারের ওপরে দাম বলছেন না ব্যবসায়ীরা। হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, আবাদে যা খরচ হয়েছে, তা–ই উঠবে না। লাভ তো দূরের কথা। বাড়ির সবাই মাঠে খেটে ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষে এবার খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকার মতো। বাদাম হয়েছে ৩০ মণ। প্রতি মণ গড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করলে আবাদের খরচই ওঠে না। মাঝখানে বন্যায় কিছু খেয়ে গেছে। কামলা খরচ বাদ দিয়ে হিসাব করলেও লস। সব জায়গাতেই কৃষকদের বিপদ।
বাজারে নতুন আলু এখন ১৫ টাকা। অথচ বীজ আলু কৃষকেরা কিনেছেন ২ হাজার টাকা মণ। অর্থাৎ ৫০ টাকা কেজি। সঙ্গে বিষ, বীজ, কামলা খরচ তো আছেই। কৃষকের ঘরে আলু। কোল্ডস্টোরগুলো যেখানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা গত বছর ভাড়া নিয়েছে ৩০০ টাকা। এ বছর ৪০০ টাকা নিচ্ছে। কৃষকের লাভ কে খায়?
শিল্পপণ্যের দাম নির্ধারণ করেন শিল্পপতিরা। এটা সারা দুনিয়াতেই হয়। সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের দামটি নির্ধারণ করেন সেখানকার কৃষকেরা। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকেরা তা পারেন না। কৃষক যে ট্রাক্টর, বীজ কেনেন, তা কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যে। আর কৃষক নিজের উৎপাদিত পাট, তুলা, বাদাম, ধানের দামটা নির্ধারণ করতে পারেন না। চাষিদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারিভাবে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করার দাবি কি খুব অপ্রাসঙ্গিক?