মূল্যস্ফীতি নিয়ে আরও উৎকণ্ঠা
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলো। ৩১ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম পুনর্র্নিধারণ করেছে সরকার। প্রতি লিটারে দাম বাড়ানো হয়েছে এক টাকা। নতুন নির্ধারিত দাম ১ ফেব্রুয়ারি থেকে থেকে কার্যকর হয়েছে। এর আগে গেল ৩১ ডিসেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক টাকা করে কমানো হয়েছিল।
তখন ডিজেলের বিক্রয়মূল্য প্রতি লিটার ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা, কেরোসিন ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা পুননির্ধারণ করা হয়। তবে প্রতি লিটার অকটেন ১২৫ টাকা ও পেট্রোল ১২১ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। আমাদের দেশের চাক্ষুষ বাস্তবতা হলো জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর ফল–নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি! আর এর ফলাফল হয় সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরণের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়া, যা সাধারণত মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ঘটে থাকে। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর সহায়তায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপাল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮ নভেম্বর এ প্রসঙ্গে গভর্নর সাংবাদিকদের বলছিলেন, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে ঋণ দিচ্ছে সবল ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ৬টি ব্যাংককে (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অফ বাংলদেশে পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি) তারল্য সহায়তা দিয়েছে। টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এ সহায়তা দেওয়া হয়। অথচ দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির জন্য গভর্নর মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্তকে বেশ সমালোচনা করতেন।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ২৯ জানুয়ারি দেশে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলকে বলেছেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তার সরকার ‘বিপর্যস্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত‘ একটি অর্থনীতি পেয়েছে। বলতেই হয়– ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থা। পুঁজিবাজার পতনবৃত্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। রপ্তানির চাকা ঘুরছে না। বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক নয়। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ভোক্তার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারার ব্যর্থতায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, শুধু প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশ অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখি। মূল্যস্ফীতি বাড়ছেতো বাড়ছেই। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা পরিবহন খরচ বাড়াতে প্ররোচিত করবে মালিকদের। এতে ন্যূনতম হলেও প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর।
অর্থনীতিতে পড়েছি জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারের কথা– ব্রিটিশ অর্থনীতি ও জনমিতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস পড়তে গিয়ে। সতরো শতকের অর্থনীতির এই পণ্ডিত বলেছেন, মানুষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্য বাড়ে গাণিতিক হারে। জ্যামিতিক হার হলো ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২ এবং গাণিতিক হার হলো ১, ২, ৩, ৪, ৫। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তে এ হারের কথা মনে পড়ে গেল।
দাতাদের পরামর্শ অনুয়ায়ী যদিও তা আগেই বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু এই মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সকল পণ্যে পড়বে। পরিবহন খরচ বাড়বে। যাতায়াত খরচ বাড়বে। জ্বালানিনির্ভর উৎপাদনকারী অতিরিক্ত খরচ আদায় করে নেবে ভোক্তা বা ক্রেতার কাছ থেকেই। মূল্য বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব হলো সাধারণ জনগণেরই নাভিশ্বাস! অর্থাৎ পরিবহন ভাড়া এবং উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা পণ্যের দাম বাড়াবে জ্যামিতিক হারে। আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধি বা অতি মুনাফাখোর মানুষের সংখ্যা অনেক। সরকার কোন পণ্যের দাম ২ টাকা বাড়ালে ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতায় টমাস রবার্ট ম্যালথাসের জ্যামিতিক হারকে অনুসরণ করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে তা বাড়ানো হয়। সরকারের মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা নতুন নয়।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখা যাচ্ছেই না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। টানা আট মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। বাজারে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন। শীতের শুরু থেকে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ বাড়লেও এখন পর্যন্ত দাম তেমন কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপও কাজ করছে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মূল্যস্ফীতি
- উৎকণ্ঠা