নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন কী সুপারিশ করল
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য দেড় শ সুপারিশ করেছে এ-সম্পর্কিত কমিশন—যেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সত্যিই একটা গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। যদিও কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া কঠিন।
বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় খুব বেশি ত্রুটি আছে, তা বলা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি নির্বাচনে রাজনৈতিক তথা ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপ—যার ফলে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, হয় না। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি দলীয় প্রতীক।
জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যে প্রভাব বিস্তার করে বা করতে পারে, সেটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা পলিটিক্যাল কালচারের সমস্যা। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নয়। কেননা, প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি করা যায়নি। যায়নি বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করতে হয়েছিল গণতন্ত্রকে পাহারা দেওয়ার জন্য। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধানটি বাতিল করে দেওয়ার পরে ২০১৪ থেকে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তার সবই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এটিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি বলার সুযোগ নেই। কেননা, এই ব্যবস্থাতেই সারা বিশ্বে ভোট হয়। কিন্তু তারপরও নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের সুপারিশ করেছে কমিশন। অবশ্য তারা সুপারিশ না করলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই ব্যবস্থাটি এখন সংবিধানে পুনরায় যুক্ত হওয়ার পথে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসময় উন্মুক্ত ছিল। অর্থাৎ দলীয় প্রতীক ছিল না। প্রার্থীদের অনেকের পেছনে দলীয় সমর্থন থাকলেও বা তাঁরা স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতা হলেও ভোট হতো নির্দলীয়। প্রার্থীদের পোস্টারে দলীয় শীর্ষ নেতার ছবি বা দলীয় প্রতীক থাকত না। ফলে যিনি যে দলের লোকই হোন না কেন, তিনি ভোট পেতেন মূলত ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।
বলাই হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ ও হানাহানি, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ভেতরে যে একটা অলিখিত সুসম্পর্ক ছিল, সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ। কেননা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী হতেও দলীয় নেতাদের মধ্যে এত বেশি প্রতিযোগিতা ও টাকার খেলা হয়েছে যে তার ফলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। মেয়র ও চেয়ারম্যান গ্রুপ এবং তার এক বা একাধিক গ্রুপ। তাতে করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে, যা ক্ষমতায় থাকার কারণে সে টের পায়নি। ৫ আগস্টের পরে নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছে যে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করে তারা নিজের কত বড় সর্বনাশ করেছে। শেষ দিকে আওয়ামী লীগ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল এবং কিছু কিছু জায়গায় দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছার ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগের মতোই উন্মুক্ত তথা নির্দলীয় প্রতীকে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু আইনটি বাতিল হয়নি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার সুপারিশ করেছে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেটি যে দলীয় প্রতীকে হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচন আদৌ এই সরকারের অধীনে হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনাও এ রকম ছিল। কিন্তু এই ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পুরোপুরি বিপরীতে। তারা কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, এ মুহূর্তে তাঁদের ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। তার মানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরে গঠিত সরকার যদি আইন পরিবর্তন করে আগের মতোই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার বিধান চালু না করে তাহলে যে ধরনের সংকট আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, তাদেরও সেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন। স্মরণ করা যেতে পারে, যখন ইভিএম চালু করা হয় তখন বলা হয়েছিল যে এটি তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। কেননা, এই সিস্টেমকে সরকারের বিরোধীপক্ষ বিশ্বাসে নেয়নি। তারা শুরু থেকেই এই মেশিনে ভোট ম্যানিপুলেট করার অভিযোগ এনেছে। যদিও সরকার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের অনেকেই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে এই মেশিনে কোনো ত্রুটি নেই বা চাইলেই মেশিনে কারসাজি করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও এটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এটার ওপর সব দলের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা যায়নি। একটি পদ্ধতি যতই ভালো হোক না কেন, সেটার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সেই পদ্ধতি চালু রাখা কঠিন।