টানটা প্রেমের, নাকি জালিয়াতের টোপ
১৩ বছর বয়সী মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অ্যালিসিয়া কোজাকিউইচের সঙ্গে অনলাইনে পরিচয় হয় ৩৮ বছর বয়সী স্কট টাইরির। প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে অ্যালিসিয়ার বিশ্বস্ততা অর্জন করে টাইরি। ২০০২ সালের নববর্ষে, পেনসিলভানিয়ার এক ঠিকানায় দেখা করার জন্য অ্যালিসিয়াকে প্রলুব্ধ করে টাইরি। অ্যালিসিয়া সেখানে উপস্থিত হলে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য এক বাড়িতে। সেই বাড়ির বেজমেন্টে শিকলবন্দী অ্যালিসিয়ার ওপর চলে ধর্ষণসহ নানা নির্যাতন এবং সেটি লাইভ সম্প্রচার করে টাইরি।
একজন গোপন তথ্যদাতার কাছ থেকে সে ভিডিওর খবর পেয়ে, আইপি ঠিকানা অনুসরণ করে চার দিন পর টাইরির বাড়িতে হানা দিয়ে অ্যালিসিয়াকে মুক্ত করে এফবিআই। পরবর্তী সময়ে এই অ্যালিসিয়া কোজাকিউইচই অনলাইন শিশুশিকারি, শিশু অপহরণ ও নিরাপত্তার মতো বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যালিসিয়া প্রকল্প। শিশু উদ্ধার প্রচেষ্টার জন্য অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য এই অ্যালিসিয়ার নামেই প্রবর্তন করা হয় অ্যালিসিয়া আইন।
ঘটনার সূত্রপাত হয় অ্যালিসিয়ার অনলাইন বন্ধু ক্রিস্টিন নামের এক কিশোরীর মাধ্যমে। এই ক্রিস্টিনই টাইরিকে পরিচয় করিয়ে দেয় অ্যালিসিয়ার সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে বেরিয়ে আসে, ক্রিস্টিন নামধারী এই কিশোরী আসলে ৩১ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবক। নকল অনলাইন পরিচয় ব্যবহার করে হয়রানি ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে অন্যদের বিশ্বস্ততা অর্জনের এই অপকৌশলের নাম ‘ক্যাটফিশিং’।
ক্যাটফিশিং নামকরণের কারণটাও উল্লেখ করার মতো। দূরবর্তী কোথাও কডজাতীয় মাছ স্থানান্তরের পর দেখা যায় মাছগুলো নিস্তেজ ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু কড মাছের ট্যাংকে যদি কয়েকটি শিং-মাগুরজাতীয় ক্যাটফিশ রেখে দেওয়া হয়, সেগুলো ট্যাংকের কড মাছগুলোকে নিস্তেজ ও ফ্যাকাশে হতে বাধা দেয়, অর্থাৎ তাজা মাছ সরবরাহ নিশ্চিত করে। চাতুর্যের নিদর্শন এই ক্যাটফিশের ভূমিকা থেকেই ক্যাটফিশিং নামটি নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
একজন ক্যাটফিশার অন্য ব্যক্তির ছবি, জন্মতারিখ, ভৌগোলিক অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য নকল করে ভান করে যে এটি তাদের নিজস্ব তথ্য। তারপর সে নকল পরিচয় ব্যবহার করে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে, অর্থ হাতিয়ে নিতে বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। অনেক ক্ষেত্রে, মানসিক জটিলতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা, প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা ইত্যাদি কারণেও মানুষ ক্যাটফিশিং করে থাকে। অনলাইন ডেটিং অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলোয় ক্যাটফিশিং অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। এফবিআইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে প্রায় ১৯ হাজার ভুক্তভোগী আমেরিকান প্রণয় প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় ৭৪০ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। ২০২০ সালে একই প্রক্রিয়ায় সিঙ্গাপুরে ক্যাটফিশাররা হাতিয়ে নেয় ২৪ মিলিয়ন ডলার, যেটি ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ মিলিয়ন ডলারে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ফ্রড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ২০২২ সালে ৮ হাজারের বেশি প্রণয় জালিয়াতির রিপোর্ট পেয়েছে, যেখানে প্রত্যেক ভুক্তভোগী গড়ে ১৫ হাজার ডলার হারিয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক (লয়েডজ ব্যাংক) আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি প্রণয় প্রতারণার শিকার হন এবং নারীদের তুলনায় প্রতারণার শিকার হওয়া পুরুষের সংখ্যা বেশি।
আমাদের দেশে কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন দেশ থেকে প্রেমের টানে ছুটে আসার খবর পত্রিকায় আসে। কীভাবে অন্য দেশের এক তরুণ বা তরুণী বাংলাদেশের কারও প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে এল, সে কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়। কিন্তু সে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে কতজন যে অর্থকড়ি থেকে শুরু করে মানসিক শান্তি হারাল, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই, পত্রিকায়ও আসে না। তবে সেটি যে উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন জায়গায় এটি এখন চক্র পরিচালিত ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। গত মার্চে, ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার কাছের এক লাভ স্ক্যাম (প্রণয় প্রতারণা) কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে সে দেশের পুলিশ ৩৮৩ জন ফিলিপিনো, ২০২ জন চীনা ও ৭৩ জন অন্য বিদেশি নাগরিককে উদ্ধার করেছে (সূত্র: বিবিসি)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জালিয়াতি
- প্রেমের টান