
প্রায় পৃথিবীজুড়েই চলছে নামমাত্র গণতন্ত্র
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ১৬ জুলাই ঢাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, ‘আমরা জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিলাম ডেমোক্রেসির জন্য। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, হয়ে যাচ্ছে মবোক্রেসি।’
বিএনপিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে—এমন অভিযোগ করেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা এই সরকারের সফলতা কামনা করেছি। আমরা এই সরকারকে সব সময় সব ধরনের সহযোগিতা করেছি। কিন্তু আজ গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে পরিকল্পিতভাবে ইস্যু সৃষ্টি করে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে।’
সরকারের উদ্দেশে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে যারা ষড়যন্ত্র করছে, তারা যেন আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। জনগণের মনে যেন এ রকম প্রশ্নের উদ্রেক না হয় যে সরকার একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।’
বিএনপি নেতার বক্তব্য এটা স্পষ্ট যে গণতন্ত্রের জন্য হাপিত্যেশ করেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা, বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্র অধরা, তখন দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্র কী অবস্থায় আছে তা একটু দেখে নেওয়া যেতেই পারে। যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে গণতন্ত্রের গুরু মানা হতো, তারাও নিজ নিজ ক্লাসে শূন্য পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত! যুক্তরাষ্ট্রে গলা ফুলিয়ে কথা বলার অধিকার থাকলেও, একে অন্যের গলা চেপে ধরার প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। আর ভারতে ভোটের উৎসব আছে, তবে বাকস্বাধীনতা যেন উৎসবের পরদিনই হারিয়ে যায়! বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের এই হাঁসফাঁস দেখে মনে হয়, আসলেই আজকাল গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যেন পুরনো প্রেম টিকিয়ে রাখার মতোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীজুড়ে কয়টি দেশে মানুষ প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনে আছে? স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও জনগণের কর্তৃত্বের যে মহৎ আদর্শ নিয়ে একসময় পৃথিবীর মানচিত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আজ তা অনেকাংশেই ক্ষয়ে যাচ্ছে—অন্তসারশূন্য হয়ে পড়ছে। আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ বৈপরীত্য হলো, আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, বিশ্বায়নের সম্ভাবনা ও গণসচেতনতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের মানের ক্রমাবনতি রোধ করা যাচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা প্রায় ৮.০৯ বিলিয়ন বা ৮০৯ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠী আজ ১৯৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রে বাস করছে—যাদের শাসনব্যবস্থা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, কিন্তু চাহিদা একটাই: মর্যাদাপূর্ণ, স্বাধীন ও মানবিক জীবন। কিন্তু এই চাহিদার সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে প্রকাশিত ডেমোক্রেসি ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাত্র ২৫টি দেশ পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। দেশগুলো হচ্ছে নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, তাইওয়ান, লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, মালটা, মরিশাস, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা, জাপান, চিলি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, স্লোভেনিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। এসব দেশে বসবাস করে প্রায় ৪৯ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৪ শতাংশ মানুষ এমন কোনো না কোনোভাবে সীমিত, ত্রুটিপূর্ণ বা ছদ্মবেশী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে বাস করছে। এই পরিসংখ্যান হতাশাজনক নয় কি?
গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়। এটি হলো একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক জবাবদিহিতা, সহনশীলতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে যে ৪৬টি দেশ ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত, সেগুলোতে নির্বাচন থাকলেও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিরোধী রাজনীতির চর্চা নানা বাধায় জর্জরিত। এসব রাষ্ট্রে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ বাস করছে, যাদের কাছে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু সেটি নিছকই নামমাত্র।
এর চেয়েও বিপজ্জনক হলো ৩৬টি দেশের ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা ছদ্মগণতন্ত্র। যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আংশিক চর্চা রয়েছে, কিন্তু সঙ্গে রয়েছে নিপীড়নমূলক আইন, নিরাপত্তা বাহিনীর দমননীতি, সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বিরোধী কণ্ঠের দমন। হাইব্রিড শাসনের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.৫ বিলিয়ন—যাদের গণতন্ত্রের স্বাদ কেবল কাগজে লেখা থাকে, বাস্তবে নয়।
অন্যদিকে পৃথিবীর ৬০টি দেশ পুরোপুরি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, সৌদি আরব, মিয়ানমার, রাশিয়া কিংবা আফ্রিকার অনেক দেশে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশ, রাজনৈতিক বিরোধিতা কিংবা নির্বাচনের অধিকার একরকম বিলুপ্ত। এ ধরনের রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২.৯৮ বিলিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ৩৭ শতাংশ। সোজা কথায়—বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজন সরাসরি স্বৈরতন্ত্রের ছায়ায় বড় হচ্ছে।