
গোপালগঞ্জের ঘটনাপ্রবাহ এবং ফ্যাসিবাদী বয়ানের রাজনীতি
গোপালগঞ্জে যে সন্ত্রাসী হামলা হলো, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করেছে। পুলিশের ওপর আক্রমণ, আর্মি ক্যাম্প ঘেরাও, বোমা ও গুলিবর্ষণ এবং মাইকের মাধ্যমে ধর্মীয় উসকানি-সব মিলিয়ে একটি সহিংস, সংঘবদ্ধ অপরাধ হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ ঘটনাটিকে দেশে প্রচলিত ‘মব সন্ত্রাস’ বা ‘ধর্মীয় উগ্রতা’র দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়নি।
প্রশ্ন উঠছে-কেন?
যদি এ হামলা কোনো ধর্মীয় পরিচয়বিশিষ্ট মুসলমানদের মাধ্যমে হতো, তাহলে মিডিয়া ও তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ একযোগে ‘মব সন্ত্রাস’, ‘ধর্মান্ধতা’, ‘উগ্রতা’ এবং ‘রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত’ ইত্যাদি শব্দে মুখর হয়ে উঠত। অথচ গোপালগঞ্জের এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেই রকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করেছে, যা বাংলাদেশের তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ সমাজের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এ বৈষম্যপূর্ণ ভাষা ও প্রতিক্রিয়ার পেছনে যে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে, তা বোঝা যায় মার্কিন দার্শনিক এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন স্ট্যানলির আলোচিত বই ‘হাউ ফ্যাসিজম ওয়ার্কস : দি পলিটিক্স অব আস অ্যান্ড দেম’ (২০১৮)-এর আলোকে। এই বইয়ে স্ট্যানলি দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো ভাষাকে বিকৃত করে ব্যবহার করে-একটি বিশেষ শ্রেণি, গোষ্ঠী বা ধর্মীয় পরিচয়কে সব ধরনের অপরাধ, সহিংসতা ও অস্থিরতার মূল উৎস হিসাবে উপস্থাপন করতে। এর ফলে একটি পক্ষের প্রতি সমাজের বিদ্বেষ তৈরি হয় এবং অপর পক্ষের অপরাধকেও বৈধতা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা ঠিক এ প্যাটার্নটাই দেখছি। যেখানে মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ধারী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামান্যতম ভুল বা বিচ্যুতিকেও ‘মব সন্ত্রাস’, ‘ধর্মান্ধতা’ বা ‘সন্ত্রাসবাদের’ তকমা দিয়ে প্রচার করা হয়। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে হওয়া বোমা হামলা, পুলিশের ওপর আক্রমণ কিংবা ধর্মীয় উসকানিও যখন ‘সেক্যুলার’ বা তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়, তখন তা আড়ালে চলে যায়।
এ নির্লজ্জ দ্বিমুখিতা শুধু নৈতিক বিচ্যুতি নয়, বরং এটি একটি গভীর রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র, মিডিয়া এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী মিলেমিশে জনগণের চেতনা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাষাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। যাকে স্ট্যানলি বলছেন, ‘ভাষাগত ফ্যাসিবাদ।’ অর্থাৎ ভাষার মাধ্যমে বয়ান নির্মাণ এবং সেই বয়ানকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সবার দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢুকে পড়ে।
গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনায় মূলধারার গণমাধ্যমগুলো যে ধরনের অনীহা ও নিরপেক্ষতার ভান করে ঘটনা উপস্থাপন করেছে, তা এ ভাষিক ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। সংবাদে ঘটনার গুরুত্ব, প্রেক্ষাপট, সহিংসতা ও এর রাজনৈতিক পটভূমি ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা হয়েছে। ‘মব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। ‘উগ্রতা’ শব্দটাও উধাও। অথচ ঠিক একই ধরনের সহিংসতা যদি ধর্মীয় পোশাক পরিহিত কারও মাধ্যমে হতো, তাহলে সেই সংবাদই হতো প্রধান শিরোনাম, সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠত, টকশো ভরে যেত উপদেশ আর সতর্কতায়।
এর অর্থ, এখানে ‘মব’ শব্দটির ব্যবহার হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে। এটি ফ্যাসিবাদের একটি কৌশল, যেখানে ‘আমরা বনাম তারা’-এ বিভাজন তৈরি করে রাজনীতিকে চালনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘আমরা’ হলো তথাকথিত সেক্যুলার ও প্রগতিশীল চেতনার ধারকরা-যারা আসলে রাষ্ট্রক্ষমতার ধারক। এবং ‘তারা’ হলো সেই বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের ধর্মীয় পরিচয় তাদের প্রতি এক ধরনের সন্দেহ ও বিদ্বেষের আবরণে আবদ্ধ করে ফেলেছে।
এ ফ্যাসিবাদী বয়ানকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে দেশের প্রশাসন ও মিডিয়ার একটি বড় অংশ। আমরা দেখেছি, কীভাবে একই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিরপরাধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে মামলা, গ্রেফতার ও হেনস্তা চলছে। অথচ যারা প্রকাশ্যে পুলিশকে আক্রমণ করছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করছে, তাদের ব্যাপারে প্রশাসনের আচরণ তুলনামূলক নরম। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সুবিধার কারণে এ সহিংসতাকে ‘ভেতরের দ্বন্দ্ব’ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে মূল অপরাধ চাপা পড়ে যায়।
এ দ্বিচারিতা শুধু প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ঢুকে পড়া ফ্যাসিবাদী বয়ানের একটি কৌশলগত প্রয়োগ। এখানেই বাংলাদেশ আজ এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক বাঁকে দাঁড়িয়ে।