ভারতকে তার বাংলাদেশ নীতি বদলাতে হবে
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। স্বৈরাচার সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এই বিজয়ের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণ নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসর কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাদে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে সাড়ে ১৫ বছরে ধরে লাগাতার আন্দোলনে থাকা দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশকে এতটা ঐক্যবদ্ধ আর কখনো হতে দেখা যায়নি। দু-একটি বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানের সব শক্তি এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে, সর্বাত্মকভাবে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে ব্যতিক্রম আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা। শুরু থেকেই তারা সরকার ও দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য দেশে-বিদেশে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে বলে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া কিছু ফোনকল থেকে বোঝা যায়, প্রকাশ্যে না এলেও তিনি ভারতে বসে এই ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত নতুন সরকারকে স্বাগত জানায় এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় সায় দেয়। পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইস্যুতে একই সুরে কথা বলতে শুরু করে, যা দেশের জনগণের মধ্যে আওয়ামী বিরোধিতার পাশাপাশি ভারত বিদ্বেষের জন্ম দিচ্ছে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেরাই বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, ভারতের সহযোগিতায় ২০১৪ সালের পর থেকে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল। পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে থেকে প্রথম চার মাস প্রকাশ্যে না এলেও গত ৩ ডিসেম্বর একটি সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেন এবং ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় অংশ নেবেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রকাশ্যে এসে প্রথম বক্তব্যেই তিনি আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজটি করলেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনা সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রোপাগান্ডাকে গণহত্যা হিসাবে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি এই কাজটি চালিয়ে যাবেন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর স্বাগত জানালেও ভারতের সঙ্গে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভারতের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি তারা স্বাভাবিকভাবে মানতে পারছে না। ভারত এটাকে নিজেদের পরাজয় বলে মনে করছে। সম্প্রতি বহিষ্কৃত ইসকন নেতা ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পর সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা, ভাঙচুর এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে।
এর আগে কলকাতায় সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও হামলার চেষ্টা করেছিল একদল উগ্রবাদী ভারতীয়। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার আগে সেখানেও কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ চলছিল। এরপরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করেছে, ভারত সরকার (ত্রিপুরার রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার) ন্যক্কারজনক এ হামলার ঘটনা ঘটতে দিয়েছে। যদিও আগরতলায় হামলার পর ভারত দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বিরোধীদের তালিকা করে ধরে ধরে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কের সভায় ভার্চুয়াল ভাষণে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পরিকল্পনাতেই গণহত্যা হয়েছে; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এখনো গণহত্যা চলছে। আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত এখন নির্বিঘ্নে শেখ হাসিনাকে এসব কথা বলতে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলছে।