প্রথম থেকেই বাহাত্তরের সংবিধান জবাবদিহিহীন ক্ষমতার উৎস
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গত সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছে। অবশেষে ২০২৪ সালে এসে ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন হলো। এই গণ–অভ্যুত্থান কি নতুন কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে? এর রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?
জোনায়েদ সাকি: দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্রকে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা দুটো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি হলো জনগণের সামনে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন হাজির করা এবং জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। জনগণের মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে গণ–অভ্যুত্থান তৈরি হওয়ার জমিন প্রস্তুত হলেও জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই ছাত্রসমাজের একটা বড় ভূমিকা আমাদের দেশে আমরা দেখেছি।
২০২৪ সালে কোটা নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের অপমানজনক বক্তব্য, দমন–পীড়ন, হত্যাকাণ্ড এ আন্দোলনকে সমগ্র সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। নির্বিচার গণহত্যা আন্দোলনকে অনিবার্যভাবে ‘এক দফা’ তথা সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। যখন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন করে, সেটা গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
এবারের গণ–অভ্যুত্থানের মোটাদাগে দুটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং যুদ্ধের ঘোষণায় প্রতিশ্রুতি ছিল, নতুন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু ’৭২ সাল থেকেই ৫৩ বছর ধরে এই রাষ্ট্রকে প্রধানত উল্টো পথে হাঁটতে দেখেছি। ‘বৈষম্যহীন’ শব্দটাকে ভিত্তি করে এবারের ছাত্র–শ্রমিক–জনতার অভ্যুত্থান ’৭১ সালের সেই প্রতিশ্রুতিকেই আবার নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। জনগণের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
গণ–অভ্যুত্থান একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক পরিসর ও জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তির উদ্বোধনের বাস্তবতাও তৈরি করেছে। এর ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়।
গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আড়াই মাস পেরিয়ে গেছে। এই সরকারের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জোনায়েদ সাকি: ছাত্র–জনতা–শ্রমিকের গণ–অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের একটি বড় সাফল্য হলো, তারা সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক চাপগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। তবে একই সঙ্গে বলতে হবে, অনেকগুলো ক্ষেত্রে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সে রকম কিছু ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থাপনার ঘাটতি লক্ষ করছি। এর মধ্যে ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্গঠন, গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে কিছু অসন্তোষ দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ কমানো যায়নি। তা ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
আপনারা তো শুধু সরকার নয়, ব্যবস্থারও পরিবর্তন চেয়েছিলেন। সেই পরিবর্তন কতটা হলো?
জোনায়েদ সাকি: জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের অপসারণ সব অর্থেই একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষের জবান খুলে গেছে বা বাক্স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। যে বিপুল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ নতুন নামে একই রকমের শাসন আর মেনে নেবে না। ফলে শুধু ব্যক্তি বা দলের নাম বদল করে অগণতান্ত্রিক শাসন দিয়ে মানুষকে আর ভুলিয়ে রাখা যাবে না। নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হবে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাষ্ট্রকাঠামো; যেখানে নিপীড়নমূলক আইন থাকবে না, ধনবৈষম্য থাকবে না; আর্থিক খাতে দুর্নীতি দূর করা হবে, সব কাজে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকবে। ধর্মীয় জাতিগত কিংবা লিঙ্গীয় পরিচয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা জীবনচর্চার পার্থক্যের কারণে কারও অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে না।