কৃষি পুনর্বাসন এখন প্রধান অগ্রাধিকার

যুগান্তর ড. জাহাঙ্গীর আলম প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:৪১

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। আকস্মিক এ বন্যায় ইতোমধ্যেই ভেসেছে ১১ জেলা। এর আশপাশের জেলাগুলোয়ও রয়েছে বন্যার প্রভাব। তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ১১ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫৪ জন। দুর্বিষহ ক্ষুধা আর রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আরও অসংখ্য মানুষ। যারা পেরেছে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে, হাটে, স্কুলে, বাঁধে, বড় সড়কে কিংবা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি, তাদের চোখের পানি বন্যার পানির সঙ্গে মিশে হয়েছে একাকার। তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ধানখেত তলিয়ে গেছে। পুকুর পরিণত হয়েছে অথই সাগরে। মাছ, হাঁস-মুরগি, গৃহপালিত পশু-ভেসে গেছে সবই। তাদের খাদ্যের অভাব, সুপেয় পানির অভাব, ওষুধের অভাব, কাপড়ের অভাব। বন্যাকবলিত এলাকায় তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আকাশের পানে তাকিয়ে পালনকর্তাকে ডাকছেন। এরই মধ্যে অনেক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছে অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য। তাদের মধ্যে আছে অনেক ছাত্র-যুবক। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর্তমানবতার পাশে। আমরা বুঝতে পারি, এদেশে এমন অনেকেই আছেন, যাদের বুকে দুঃসময়ে দুঃখী মানুষের জন্য দরদ আছে। দুদিন আগে যে ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছিল, আজ তারা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ জোগাচ্ছে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও ঝড় ও বন্যা হয়েছে। আমরা নিজেরা সাধ্যমতো চাঁদা দিয়ে অর্থ জুগিয়েছি। তারপর দলবেঁধে চলে গিয়েছি নেত্রকোনার হাওড়ে, নোয়াখালীর চরে বা আশপাশের দুর্গত এলাকায়। এবার ছাত্রদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে অনেক সাধারণ মানুষ। শুকনা খাবার, নগদ অর্থ নিয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের পাশে। যেন অনেক আস্থা, অনেক ভরসা পাচ্ছে এ প্রজন্মের ওপর।


সাধারণত বন্যা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। অতিরিক্ত বর্ষণই বন্যার প্রধান কারণ। এবার বন্যা হয়েছে বিলম্বে, ভাদ্র মাসে। স্বাভাবিক বর্ষাকাল পেরিয়ে শরতের শুরুতে বন্যা। এ সময় নদী, খাল, বিল, পুকুর, ডোবা পানিতে টইটম্বুর থাকে। এর ওপর অতিবর্ষণ হলে বন্যার রূপ হয় ভয়ংকর। ১৮ থেকে ২২ আগস্ট দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টি হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও। এ দুটি অঞ্চলে বৃষ্টির রেকর্ড ছিল ১৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটারেরও বেশি। এমন অতিবৃষ্টিই ছিল চলমান বন্যার প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সাগরের নিম্নচাপ। ত্রিপুরা বাংলাদেশের উজানে থাকায় পানি এসে নেমেছে আমাদের পূর্বাঞ্চলে। সেই সঙ্গে স্থানীয় অতিবৃষ্টি পানির স্তর বাড়িয়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা দুর্বল থাকায় এবং সাগরের নিম্নচাপের কারণে বন্যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি হয়েছে বেশি। এর আকস্মিকতার কারণ অবশ্য ভিন্ন। আমাদের উজানে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ায় পানির স্তর বৃদ্ধি পায় ভাটি অঞ্চলে। এর কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কীকরণ ছিল না। ফলে আমাদের জানমালের ক্ষতি হয়েছে বেশি। তবে বাংলাদেশের মানুষ ঘনঘন বন্যা মোকাবিলা করে অভ্যস্ত। এর সঙ্গে অভিযোজনেও পারদর্শী। এর আগে উনিশ শতকে এদেশে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছে মোট ছয়বার। বিশ ও একুশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ১৮ বার। স্বাধীনতার পর আমরা বড় বন্যা দেখেছি ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৭ ও ২০১৬ সালে। প্রতিবারই বন্যা শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। এগিয়ে গেছে অর্থনীতি। এবারের বন্যা-পরবর্তী সময়েও এর ব্যতিক্রম হবে না।



এবার দুর্গত এলাকায় বন্যার ভয়াবহতা বেশি হলেও এর ব্যাপ্তি তেমন বেশি নয়। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা বন্যাকবলিত। অন্যান্য এলাকায় বন্যার তেমন প্রাদুর্ভাব নেই। তবে যেখানে পানির উচ্চতা বেড়েছে, সেখানে গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের সহায়সম্বল সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যার পানি। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সঙ্গী করে সেখানে বেঁচে আছে অসংখ্য মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। এসব অঞ্চলে নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে বাড়িঘরে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, সেতু-কালভার্ট ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ। থেমে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। কৃষিবহির্ভূত ক্ষুদ্র্র কারখানা ও কুটিরশিল্পও থেমে গেছে। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। বন্যায় কৃষি খাতের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা খুবই দৃশ্যমান। অনেক এলাকায় পাকা আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমন ধানের খেত সবই ডুবে গেছে। বিভিন্ন সবজি যেমন: মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পটোল, ঢ্যাঁড়শ, করলা, ঝিঙা, বেগুন এবং মসলা ফসল হলুদ, মরিচ তলিয়ে গেছে পানির নিচে। তেলজাতীয় ফসল চিনাবাদাম, তিল, সূর্যমুখী পানির নিচে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদা, লটকন, ড্রাগন ফল নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া মাছের ঘের বিনষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষ করা মাছ। বাড়িতে পালিত হাঁস-মুরগি মরে গেছে। গবাদি পশু খুব কমই বেঁচে আছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বড়। এর প্রকৃত পরিসংখ্যান ও ক্ষতির প্রকৃতি নির্ণয় করা প্রয়োজন। তাছাড়া স্থানীয় বাজারগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আকাল পড়েছে। সব পণ্যেরই সরবরাহ কম, দাম বেশি। এ দুঃসময়েও মুনাফা লুটছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এখনো কার্যকর রয়েছে তাদের সিন্ডিকেট। স্থানীয় চিড়া-মুড়িসহ বিভিন্ন শুকনা খাবারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি নৌকা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেও মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এক মহাকষ্টে দিনাতিপাত করছে বন্যাদুর্গত মানুষ।


অনেকেই বন্যাকে সমর্থন করেন। তারা বলেন, বন্যায় জমির উপরিভাগে পলিমাটির স্তর পড়ে। তাতে বেড়ে যায় মাটির উর্বরতা শক্তি। তাই বন্যার পর ফসল ভালো হয়। এক্ষেত্রে বর্ষা ও বন্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে। বর্ষা এদেশে প্রতিবছরই আসে। স্বাভাবিক বর্ষায় অপেক্ষাকৃত নিচু জমি তলিয়ে যায়। তাতে পলি জমা হয়। কিন্তু বন্যা হয় মাঝেমধ্যে, কয়েক বছর পর একবার। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রধান কারণ থাকে উজানের ঢল। তাতেও ঘোলা পানি আসে পলিমাটি সঙ্গে নিয়ে। এ সময় জনগণের ভোগান্তি বেশি হয়। অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমা ছাড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে পুনর্বাসন খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। তা খুবই কষ্টসাধ্য ও বড় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। বন্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি নির্ভর করে এর স্থায়িত্বের ওপর। ১৯৮৮ সালের বন্যা আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ১৯৯৮ সালের বন্যারও স্থায়িত্ব ছিল প্রায় দুই মাস। এবার অল্প সময়ের ব্যবধানেই পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এর গতি খুবই মন্থর। বন্যার পানি সাগরে নামার পথে প্রতিবন্ধকতা, চরার সৃষ্টি ও নদীর নাব্য হ্রাস এর প্রধান কারণ। দ্রুত এর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।


বন্যার পর কৃষির পুনর্বাসনই আমাদের বড় অগ্রাধিকার। পানি সরে গেলে জমিতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ শুরু করে গ্রামের কৃষক। কারণ, তাদের খাদ্য নিরাপত্তা দরকার। তাতে সে বিনিয়োগ করে বেশি। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় সরকারি সহায়তা পেলে চাষাবাদে উৎসাহ বেড়ে যায় কৃষকের। অধিক উৎপাদন থেকে বাজারজাত উদ্বৃত্ত বেশি হয়। পণ্যমূল্য হ্রাস পায়। তাতে লাভবান হয় ভোক্তারা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও