সবাইকে সবসময় বোকা বানানো যায় না
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষ ভারতে গিয়ে সেখানকার বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং গ্রহণের মাধ্যমে পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। আর এ বিষয়ে আমার বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলাই আজকের লেখাটির মূল লক্ষ্য। প্রথমেই আমি মুক্তিযুদ্ধকালে আমার ভারতে অবস্থানকালীন কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই।
১৯৭১ সালের মে মাসে সীমান্ত অতিক্রম করে এক সন্ধ্যায় আমরা ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছাই। অতঃপর রাত ১০টা নাগাদ আমাদের পাবনা জেলার আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত হন, যাদের মধ্যে গোপাল নামক একজন হিন্দু যুবক ছিলেন। এ অবস্থায় গোপালকে দেখে ক্যাম্প ইনচার্জসহ তার সঙ্গী দু-একজন কানাঘুষা শুরু করে দেন। কারণ গোপাল পাবনা জেলা হোসিয়ারি শ্রমিক সংগঠনের একজন সদস্য ছিলেন। আর এ সংগঠনটির নেতৃত্বপ্রদানকারী প্রায় সবাই ভাসানী-ন্যাপের নেতাকর্মী ছিলেন। গোপাল ছিলেন এসব নেতার একজন সক্রিয় কর্মী। হোসিয়ারি শ্রমিক সংগঠনটির কোনো সভা-সমাবেশের প্রাক্কালে একটি রিকশার হুডের সঙ্গে মাইক লাগিয়ে গোপাল সেই সভার প্রচারণা চালাতেন। সে অবস্থায় গোপালকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে দেখে ক্যাম্প ইনচার্জ এবং আরও দুজন তাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন এবং একপর্যায়ে তাকে পার্শ্ববর্তী শুকনো খালের মধ্যে নিয়ে গিয়ে জবাই করে হত্যা করেন। কিছুটা দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে পেয়ে আমার গা শিউরে উঠল। রাতে কিছু খেতে পারলাম না এবং সারা রাত ঘুমও হলো না। শেষ রাতে গায়ে জ্বর এলো এবং সেই সঙ্গে চোখওঠা (ভাইরাস) রোগে আক্রান্ত হলাম। সে সময়ে ক্যাম্পের আরও কয়েকজন চোখওঠা রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোগটিকে স্থানীয়ভাবে ‘জয়বাংলা রোগ’ নাম দেওয়া হয়েছিল; কারণ রোগটি বেশ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে অবস্থায় পরদিন জ্বর কিছুটা কমে এলেও ভাইরাসআক্রান্ত আমার চোখ দুটি আরও বেশি করে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠায় অবশেষে ক্যাম্প ইনচার্জকে বলে চোখের চিকিৎসার জন্য আমি কলকাতা চলে যাই। সেদিন আমরা দুজন কেচুয়াডাঙ্গা থেকে একটা লরিতে প্রথমে কৃষ্ণনগর পৌঁছে, পরে কলকাতাগামী একটা ট্রেনে চেপে বসি। আর কলকাতা যাওয়ার পথে ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য ভারতীয় মুদ্রা না থাকায় বিনা টিকিটেই যাত্রা শুরু করি। তাছাড়া শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে আসা বাংলাদেশিদের টিকিট ছাড়াই ভ্রমণ করতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! চেকার এসে টিকিট চাওয়ায় টিকিট নেই বলায় তিনি খিস্তিখেউড় শুরু করে দিলেন। গায়ের কাপড়-চোপড় এবং কথা শুনে বুঝে ফেলে বললেন, ‘ও, জয় বাংলা থেকে এসেছ, এখানে কী করতে এসেছ?’ মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি বলায় তিনি গলা আরও এক ডিগ্রি চড়িয়ে বললেন, ‘তো এখানে এসেছ কেন, যাও দেশে যাও, সেখানে থেকে যুদ্ধ করো। ইন্ডিয়া এসেছ, ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করলে পরে বুঝবে ইন্ডিয়া কী চিজ, যাও দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করো।’ উল্লেখ্য, তার বক্তব্যের আরও কিছু অংশ অশালীন ছিল বিধায় এখানে তা বাদ দেওয়া হলো।
অতঃপর টিকিট চেকার চলে গেলে ভোরবেলা আমরা শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে সোজা প্রিন্সেভ স্ট্রিটের বাংলাদেশ মিশন অফিসে গিয়ে দেখি একজন পিওন বা চৌকিদার গোছের লোক ছাড়া অত সকালে সেখানে কেউ নেই। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে বলে অগত্যা সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি কটি টাকা ভাঙিয়ে ইন্ডিয়ান রুপি করে নাস্তা সেরে আট আনার আঙুর কিনে পাশের ছোট্ট একটি পার্কে গিয়ে বসলাম। সেখানে বসে আঙুর খাওয়া অবস্থায় প্রায় ত্রিশ বছর বয়সি একটি যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে এলে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় বিনিময়ে জানতে পারলাম তিনি সিপিআইএমের একজন কর্মী বা স্থানীয় নেতা গোছের কেউ। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধে এসেছি শুনে তিনিও সেই টিটি সাহেবের মতো একই সুরে বললেন, নিজ ভূমিতে থেকেই আমাদের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত রাখা উচিত। আর কারণ হিসাবে তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার পেছনে একটি বিরাট উদ্দেশ্য আছে; এটি ভারতের একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। তিনি আরও অনেক কথাই বললেন, যা শুনে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
এ ঘটনার পর সেদিন আরও একটু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে আবারও বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পাবনার এম মনসুর আলী, যিনি আমাদের সবার প্রিয় মনসুর চাচা, তার সাক্ষাৎ পেলে চোখের চিকিৎসার জন্য তার কাছে কিছু টাকা চাওয়ায় তিনি আমার চোখের অবস্থা দেখে কিছু টাকা দিলে আমি চোখের ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি আমাকে একটি মলম ও আইড্রপ দেন। অতঃপর সেসব ওষুধ ব্যবহারে আস্তে আস্তে আমার চোখও ভালো হয়ে যায়। কলকাতা পৌঁছানোর পরদিনই আমরা আবার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফিরে আসি এবং এবারে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একদিন থেকে পরদিনই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। তারপর এক রাত সীমান্তের একজন কৃষকের বাড়িতে অবস্থান করে পাবনা চলে আসি।
পাবনা এসে দেখতে পাই সেখানকার অবস্থা খুব খারাপ; ইতোমধ্যে পাক আর্মি অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে; অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে; আমাদের পাশের বাড়ির এক গৃহবধূকে ধর্ষণও করা হয়েছে। এসব দেখেশুনে মনের আগুন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল! সে অবস্থায় পরদিন সকালে পাক আর্মি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করল এবং আমাদের বাড়ির পাশে কালীবাড়ি নামক স্থানে হেলিকপ্টারের গুলিতে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হলেন। তাছাড়া হেলিকপ্টারের গুলিতে আমাদের বাড়ির আশপাশের কারও কারও ঘরের টিনের চালা ভেদ করতে থাকায় আমরা সপরিবারে চরঘোষপুরে আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং সেদিন শেষ রাতেই পাক আর্মিকে ধ্বংস করার দৃঢ় মনোবল ধারণ করে আবারও শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে যোগদান করি। শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মূলত গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দেওয়া হতো, যাতে করে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাক আর্মিদের নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে। শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পের কমান্ডে ছিলেন ঈশ্বরদীর প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জসীমউদ্দিন মণ্ডল। সেখানে ট্রেনিং গ্রহণকালীন একদিন আমাদের পাবনার মকবুল হোসেন সন্টু শিকারপুর ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে আমাকে একটু ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে বললেন, কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে অবস্থায় তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে এখানে চলে এসেছেন। তিনি একথাও বললেন, তার শিকারপুর অবস্থানের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। উল্লেখ্য, মকবুল হোসেন সন্টু বয়সে আমার চেয়ে প্রায় সাত-আট বছরের বড় এবং তিনি ছাত্র ইউনিয়নের একজন বড় নেতা, তথা ন্যাপ-ভাসানীর একজন কর্মী ছিলেন। সে অবস্থায় আমি নিজে তাকে তিন দিন আমাদের ক্যাম্পে প্রায় গোপন অবস্থায় রাখার পর তিনি উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহণের জন্য অন্যত্র চলে যান। অতঃপর আমি স্বল্পকালীন গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ শেষে পাঁচজনের একটা দল নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সীমান্ত এলাকায় একজন শেল্টার মাস্টারের বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ