প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হোক রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি একযোগে পদত্যাগ করেছেন। দেশের ২৫তম বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এতজন বিচারপতির একযোগে পদত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশে এর আগে ঘটেনি। প্রশ্ন হলো, বিচারপতির মতো সাংবিধানিক পদ থেকে তারা ইস্তফা দিলেন কেন? অভিযোগ উঠেছে, পদত্যাগকারী বিচারপতিরা দলীয় আনুগত্যের কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছিলেন।
বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে তারা মাঝে-মধ্যে এমন সব মন্তব্য করতেন, যা তাদের বিতর্কিত করে তোলে। একজন বিচারপতি কিছু দিন আগে বলেছিলেন, তারা হচ্ছেন বিধিবদ্ধ রাজনীতিবিদ। একজন বিচারপতি কখনোই এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। বিচারপতি হচ্ছেন জমিনে আল্লাহ্র প্রতিনিধি। যেভাবে বা যারাই তাকে নিয়োগ দেন না কেন, বিচারকের আসনে বসে তিনি কখনোই কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ প্রদর্শন করতে পারেন না। আগেকার দিনে বিচারকদের সবসময় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখা হতো, যাতে কারও দ্বারা প্রভাবিত না হন; কিন্তু এখনকার বিচারকদের অনেকেই বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেও দ্বিধা করেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিগত সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের কাছ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ বিধিমোতাবেক কোনো বিচারপতি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই রাজনৈতিক কার্যক্রম বা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন না। ছাত্র আন্দোলন চলাকালে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে কোর্টের রায় পরিবর্তন করা যায় না। আন্দোলনের মাধ্যমে কোর্টের রায় পরিবর্তন করা যায় কিনা, তা ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বলেই এসব বিচারককে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
শুধু বিচারপতিরা নন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। অবশিষ্ট যারা আছেন, তারাও পদত্যাগ করার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা উপাচার্য হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও দলীয় আনুগত্যের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিগত সরকার আমলে অবস্থা এমন হয়েছিল, কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেই শীর্ষ পদে দলীয় আনুগত্য ব্যতীত কাউকে নিয়োগ দেওয়া হতো না। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হলে, তার পরবর্তী ধাপের কর্মকর্তাদের মাঝে হতাশা নেমে আসতে বাধ্য। আর একজন হতাশ মানুষের কাছ থেকে কখনোই সর্বোত্তম সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের অনেকের মাঝেই একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আমরা মনে করি, জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকার। কাজেই সরকার চাইলে তার ইচ্ছামতো ওইসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে তার পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক নন। সরকার জনগণের পক্ষ থেকে তাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের আমানতদার মাত্র। চারটি আবশ্যিক উপকরণের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে-নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব এবং সরকার। উপকরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ হচ্ছে সরকার। সরকারের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নেই। সরকার হচ্ছে জনগণের সম্পদের পাহারাদার মাত্র।
দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হলে, সেই প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ বিপন্ন হতে বাধ্য। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগদানের প্রবণতা দিন দিন শুধুই বেড়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালীন বিএনপির বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দলীয়করণের অভিযোগ উত্থাপন করত। কিন্তু তারা ক্ষমতায় আসার পর দেখিয়ে দিয়েছে, দলীয়করণ-আত্মীয়করণ কাকে বলে! এছাড়া রয়েছে দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগদান। ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান ১৩-১৪ বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তার কিছু হয়নি। কারণ, তিনি একটি বিশেষ পরিবারের আত্মীয়। এ ধরনের শত শত উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুন না কেন, তার নির্দেশমতো নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে সততার সঙ্গে পালন করা। কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা যুক্ত হতে পারেন না। এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যে নির্বাচিত অফিসার সমিতি থাকে, তার কর্মকর্তারাও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো দরকষাকষিতে যেতে পারেন না। তারা কোনো সমস্যা দেখা দিলে কর্তৃপক্ষকে তা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন মাত্র; কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি?
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকারদলীয় সমর্থনে বিভিন্ন পরিষদ গঠন করে প্রকাশ্যে রাজনীতি চর্চা চলে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তাদের সমর্থনে পরিষদ গঠন করা হয়। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকে, তার সমর্থনে কোনো পরিষদ কার্যকর দেখা যায় না। অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চর্চা করেন, তারা দলের সুহৃদ নন। তারা সুযোগ সন্ধানী এবং সুবিধাভোগী। এদের কারণে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতার আসীন হয় না; বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা হ্রাসে এরা ভূমিকা পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যারা রাজনীতি চর্চা করেন, তাদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য থাকে অতীত অপকর্ম থেকে রক্ষা পাওয়া অথবা নতুন করে দুর্নীতি-অপকর্ম করা। এদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন কাজের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে তদবিরে ব্যস্ত থাকেন। এভাবে তারা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন।