গালগল্পের সময়
২০২৪-এ ছাত্র জনতা যে পটপরিবর্তন ঘটাল দেশে, বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েও তা পেরে ওঠেনি। কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলো শোডাউনে সক্ষম হলেও মূলত তাদের জনসংযোগ ও জনস্বার্থের বিষয়গুলো ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও জন-অবহেলিত। টাকা খরচ করে মিছিল-মিটিং করলেও দিন শেষে কোনো লাভ হয়নি। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বও পরিবর্তন আনার মতো যৌক্তিকভাবে শক্তিশালী ছিল না। ছাত্রদের অরাজনৈতিক একটা আন্দোলন কী করে এমন পট-পরিবর্তন আনতে পারে, আচমকা একটা দেশে তা নিয়ে যেমন অনেকের মধ্যে বিস্ময়কর অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, তদ্রূপ অনেকের মধ্যে গল্পচারিতার খোরাক জুগিয়েছে। এ দেশের মানুষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সুযোগ ও সময় মিললেই তারা গল্পে মশগুল হয়। যার যেমন অভিজ্ঞতা ও কল্পনা, সে তার ওপরই নির্ভর করে গল্প রচনা করে। যা হোক, ছাত্র-জনতার যে গণ-অভ্যুথান, তা এতটা বেগবান হওয়ার পেছনে কী ছিল, কী কাজ করছে—এমন প্রশ্নের জবাবও একটা নয়, অনেক এবং সেটা প্রত্যেক ব্যক্তির পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে বাজারে অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে ইতিমধ্যে। তবে একটা সাধারণ ধারণা কমবেশি প্রায় সব গল্পেই জায়গা করে নিয়েছে। সেটা হলো, বৈষম্য আর দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিল। মনেপ্রাণে তারা পরিত্রাণ চাইছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
তা ছাড়া ছাত্রদের বুকে গুলি চালানো সহ্য করতে পারে—এমন মানুষ সম্ভবত একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্ররা তো কারও সন্তান, ভাইবোন, স্বজন। প্রিয়জনের বিভীষিকাময় মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো একটাও মানুষ নেই। তবে যারা গুলি করে এবং যারা গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাদের কথা ভিন্ন। কখনো-সখনো রাজ্য শাসনের জন্য তারা অমানবিক হয়, পাশবিকতার পরিচয় দেয়। রাজ্য শাসনে নাকি এ রকম ঘটনা ঘটেই থাকে ক্ষমতা ধরে থাকার জন্য। তথা মানবতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে হয় শাসকদের। সব শাসনামলেই শাসকেরা একটা পর্যায়ে এসে এমন অমানবিক আচরণ করে। যদিও এমন আচরণের পেছনে তাদের একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও কারণ থাকে। এ ধরনের উদ্দেশ্য ও কারণ শেষ অবধি টেকে না। ইতিহাস কিন্তু সে কথাই বলে আসছে। শুরুতে ছাত্রদের কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটা কোনো রাজনৈতিক দলীয় ব্যানারে ছিল না। যদিও এখনো তেমন ব্যানার নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভেঙে ফেলা, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা তাদের নির্দলীয়তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করলেও করতে পারে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে বিগত সরকারের উচ্চপদস্থ ও দলীয় লোকদের ভয়াবহ দুর্নীতির বিষয়টিও সাধারণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। জনগণ মনে করেছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক ব্যর্থতা ছিল, ছিল স্বজনপ্রীতি। ফলে রাজনৈতিক দলের বাইরের ছাত্রদের এই অরাজনৈতিক ও অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সমর্থন সহজেই যুক্ত হয়ে যায়। স্বয়ং সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে বলছিলেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এবং তিনি হেলিকপ্টারে চলাচল করে থাকেন, তখন কিন্তু জনমনে এমন বার্তা ভালো কিছুর অর্থ পৌঁছায় না, ক্ষোভের সঞ্চার করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চতুর্পাশ নিয়ে নানান নেতিবাচক গল্পের অবতারণা হয়। এমন কথা প্রকাশ্যে বলার কী মানে হয়, তাঁর কৃতিত্ব বা ব্যর্থতাকে কোথায় নিয়ে যায় ইত্যাদি তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়ার কেউ কি কখনো তাঁর পাশে ছিল না? অবশ্য লোকে বলে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই করেন এবং বলে থাকেন।
কেউ কেউ এই অভাবনীয় আন্দোলনের পেছনে ইন্ধনদাতার, নেতৃত্বদানকারীর অনুসন্ধান চালিয়েছে। বিশেষ করে সরকারপন্থী ও সমর্থনকারীরা মনে করে যে, এমন গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে আমেরিকার সম্পৃক্ততা ছিল। তাদের ধারণা জোরালো হয়, যখন দেখা গেল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই চাইছে। ড. ইউনূসের প্রতি আমেরিকার বিশেষ মনোভাব, বিবেচনা ইতিমধ্যে সবারই জানা আছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে ড. ইউনূসকে তার প্রাতিষ্ঠানিক কিছু অনিয়মের অভিযোগে মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন হতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রাক্কালে তিনি এই মামলা-মোকদ্দমা থেকে রক্ষা পান, মুক্ত হন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এমন ধারণাকারীদের মতে, অঙ্কের ফলাফলটা ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এবং চূড়ান্ত হয়েছে।