![](https://media.priyo.com/img/500x/https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_394832_1.jpg?t=1723521914)
গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক উন্নত ও বাসযোগ্য রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে
দেশ স্বাধীনের আগে যে কয়টা আন্দোলন হয়েছে, বয়সে ছোট হলেও অনেকগুলোয় আমার অংশগ্রহণ ছিল। দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬২ সালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্টের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এরপর ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মোটামুটি আমার ভালোই ভূমিকা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক (পূর্বে ইকবাল হল) হলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয় আমাদের হল থেকেই। সেই আন্দোলনে আমার সামান্য ভূমিকা ছিল। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কোনো তুলনা হয় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো আন্দোলনে এত নৃশংসতা, বর্বরতা ও প্রাণহানি ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সবাই চেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করবেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। আমাদের বঞ্চিত করে। শুধু বঞ্চিত করাই নয়, তারা সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২৪ সালে এসেও মানুষকে তার অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা রোগের উপসর্গ। আর রোগ হলো মানুষের বঞ্চনা, অধিকারহীনতা, ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া, নগ্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বর্বরতা। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে আবরার হত্যাসহ বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতন, অধিকারহীনতা দিন দিন বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মূলত এগুলোই রোগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আমি জুলাই ও আগস্টের সহিংসতার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো তফাত দেখি না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল। আমরা অধিকার চেয়েছিলাম, তারা অধিকার দিতে চায়নি। কারণ তাদের স্বার্থ জড়িত ছিল। কিন্তু আমরা এখন একই দেশের নাগরিক। আমাদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। দেশের ছাত্রসমাজ অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, সে অধিকার তো আমাদের সবার এবং সবার স্বার্থে। উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যেই করেছে। সরকার ইতিহাসের নৃশংসতম বর্বরতার মাধ্যমে চার শতাধিক শিক্ষার্থী, শিশু ও কিশোরসহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। আহত করেছে কয়েক হাজার ব্যক্তিকে। গ্রেফতার করেছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। তারা শুধু যে খুনখারাবি করেছে তা-ই নয়, পুরো দেশটাকেই কারাগারে পরিণত করেছে। তাই আমি মনে করি, এসব কর্মকাণ্ড যারা করছেন তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো তফাত নেই, যা আমাকে ব্যথিত করে, আমাকে ক্ষুব্ধ করে, প্রতিবাদী হতে আমাকে উৎসাহিত করেছে। এসব হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে। পতনের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
বর্তমানে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের ছাত্র সংগঠনকে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছে। আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, কিন্তু ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সেই পরিচয় দিতে এখন আমার লজ্জা লাগে। বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো নীতি কিংবা আদর্শ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে ছাত্র সংগঠনগুলোকে অপব্যবহার করছে। তাদের দিয়ে অন্যায়, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করানো হয় এবং তারা নিজেরাও এর থেকে লাভবান হয়। আগের ও বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি এক নয়। আমাদের সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এর মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ হতো। ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করত। আমরাও ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণে কাজ করেছি।
আর এখন চলছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, অধিকার হরণ, বিভিন্নভাবে নিগ্রহ ও নিপীড়ন। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তার প্রাণহানি ঘটল কেন? লেজুড়বৃত্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন মানিক উরফে সেঞ্চুরিয়ান মানিক শততম ধর্ষণ প্রকাশ্যে উদযাপন করে। তার কোনো বিচার হয়নি, বরং তাকে নিরাপদে পালাতে (সেফ এক্সিট) সাহায্য করা হয়েছে। তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে একের পর এক অন্যায়গুলোই এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এগুলোই হলো রোগ। আর কোটা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলন রোগের উপসর্গ। যেমন কারো যদি জ্বর কিংবা ম্যালেরিয়া হয়, তখন প্যারাসিটামল খেলে জ্বর কমে যাবে। কিন্তু আবার ফিরে আসবে। কারণ রোগ নির্মূলের চিকিৎসা হচ্ছে না, বরং ওষুধ খেয়ে রোগকে থামিয়ে রাখা হচ্ছে।