বৈসাদৃশ্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
নিজেকে বোঝার জন্য মাঝেমাঝে স্মৃতি হাতড়াতে হয়। কোনো একটা লেখায় পড়েছিলাম, ভালো ও মন্দ স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা মানুষকে ঋদ্ধ করে। আর সেই অবস্থার সাথে যখন মানুষ বর্তমান সময়কে তুলনা করতে বা মেলাতে পারে, তখন ভবিষ্যত হয় সুন্দর। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে আমরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্য কোনো মেলবন্ধন ঘটাতে পারছি না। সেরকমই একটি জীবনের গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু করছি, যেখানে অতীত আছে, বর্তমানও জড়িয়ে আছে ওই অতীতকে ঘিরে।
একটা সময় অর্থাৎ ৭০/৮০ এর দশকে ঢাকা শহরের অসংখ্য বাসার মধ্যে হয়তো মাত্র কয়েকটি বাসাতেই টেলিফোন ছিল। খুব বনেদি বা ধনী বাড়িতে টেলিফোন নামক যন্ত্রটি থাকতো এবং সেটা সাধারণত বসবার ঘর বা ড্রয়িং রুমেই সাজানো থাকতো। অবাক করা ব্যাপার হলো, এরকম একটা সময়ে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাড়িতেও একটা ফোনের লাইন লেগেছিল, অবশ্য সেটা আব্বার চাকরির সুবাদে।
১৯৭৩ সালে বাসায় প্রথম ফোনের লাইন আসার পর আমরা সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। বাসায় ফোন থাকাটা যে খুব অভিজাত বিষয় সেটা বুঝতে পারলেও, ফোনটা ব্যবহার করবো কিভাবে বা কাকে ফোন করবো সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ তখন আমাদের পরিচিত কারো বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল না। শুধু নারিন্দার ডাক্তার চাচার বাসায় ও জাহানারা ইমাম মানে জাহানারা চাচিদের বাসায় ফোন দেখেছিলাম। ফলে ভাইবোনরা একত্রিত হলেই ফোন তুলে ’হ্যালো হ্যালো’ বলে খেলতাম। আমাদের ফোন নাম্বারটি ছিল ৩১১৩২৩। এরপর এই নাম্বারে আর কোন পরিবর্তন হয়নি।
ফোন আসার পর প্রতিবেশিদের অনেকেই ফোনটা দেখতে আসতেন। কারণ তাদেরও হয়তো ফোন করার তেমন কেউ ছিল না। তবে আর কয়েকবছর পর এই ফোনটির ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অবাক করা ব্যাপার ছিল এই যে আশির দশকে এসে এই ফোনটা দিয়ে কথা বলেনি, আমাদের পরিচিত বা অপরিচিত এমন কোন বাসা ছিল না। যতদূরের বাসাই হোক কারো ফোন এলে আমরা ডেকে দিতাম। এজন্য অবশ্য সময় লাগতো। একবার ফোন করে কাউকে ডাকার অনুরোধ করা হতো, আরেকবার সেই ব্যক্তি এসে কথা বলতেন, যা এখন কল্পনারও বাইরে।
আসাদগেট নিউকলোনিতে আসার পর বিল্ডিংয়ের ১২ টা পরিবারের ফোন, অন্য বিল্ডিংয়েরও কারো কারো ফোন, আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ফোন আসতে শুরু করলো এই নাম্বারে। সবাই নির্দ্ধিধায় নিজেদের ফোন নাম্বার মনে করে, এই ৩১১৩২৩ নাম্বারটি দিয়ে আসতো তাদের পরিচিত জনকে। আব্বা আমাদের এমন একটা ধারণা দিয়েছিল যে ফোন অতি প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। কারো ফোন এলেই তাকে যেন ডেকে দেয়া হয় এবং অন্যকে ফোন করতেও দেয়া হয়।
আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীর প্রেম, ভালোবাসা, ঝগড়াঝাটি, অসন্তোষ, ভালো খবর, খারাপ খবর সব এই ফোনের সুবাদে আমাদের দরজায় হাজির হতো। আমাদের বাসাটিকে আজকের দিনের ‘কমিউনিকেশন হাব’ বলা যেতে পারে। আমরা সবার খবর পেতাম এবং কেমন করে যেন সেই খবরগুলোর সাথে নিজেরা একাত্মও হয়ে যেতাম। আত্মীয়ের অসুখ, বোনের বিয়ে, ভাইয়ের চাকরি, গ্রামের বাড়ির বন্যা-খরা, পরীক্ষার ফলাফল এগুলো সব খবর এসে পৌঁছাতো প্রথমে আমাদের বাসায়। ফোনের মাধ্যমে যে বিয়ে হতে পারে, আমরা প্রথম তা জানতে পেরেছিলাম ১৯৭৬ সালে। বোনের বিয়ে হয়েছিল ঢাকা-জার্মানি। এমনকি বিয়ের ঘটকলি, বিয়ে ভাঙা, সংসার ভাঙা ও জোড়াতালি দেয়া সব ঘটেছে এই ফোনের মাধ্যমেই। কতজনকে প্রেম করতে দেখেছি, রং নাম্বারে কথা বলতে দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
আরেকটা ঐতিহাসিক ব্যাপার ছিল এই ফোনকে কেন্দ্র করে। কারণ এই নাম্বারের সবচেয়ে কাছাকাছি নাম্বার ছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ এর বাসার, সেই নাম্বারটি ছিল ৩১১৩২১। ফলে ওনার বাসার এন্তার ফোন রং নাম্বার হয়ে আমাদের নাম্বারে চলে আসতো। তখনই আমরা ঐ বাসার ছেলেমেয়েদের নাম জেনে গিয়েছিলাম সিমিন, রিমিন এবং তাজ। জোহরা তাজউদ্দীনেরও ফোন আসতো। হয়তো পাশাপাশি নাম্বার বলে এই নাম্বারটাই রং নাম্বার হতো। এমনকি ৪২০ কিলোমিটার দূরের খাটুরিয়া গ্রাম থেকে সবাই এই নাম্বারেই ট্রাংকল করতো ঢাকা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায়। ওই গ্রামের সবার একটাই নাম্বার ছিল ৩১১৩২৩।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আর্থ-সামাজিক অবস্থা