বড় পদে ছোট মানুষ নয়
ছাগলের সব কাণ্ড তাহলে ছাগলামি নয়—মানে তুচ্ছার্থে ব্যবহার্য নয়। তাকে নিয়ে কোনো কিছু বলার আগে দশবার চিন্তা করতে হবে। কেননা ছাগলও দিতে পারে অনেক গূঢ় রহস্যের সন্ধান। সহায়তা করতে পারে অনেক বড় দুর্নীতির আবিষ্কারে।
কোন ঘটনা দিয়ে শুরু করব? এটা ভাবনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেনজীরকাণ্ড, আনার হত্যাকাণ্ড, আজিজ আহমেদ, আছাদুজ্জামান, মতিউর রহমান, রফিকুল ইসলাম, কাজী ফয়সল...! একটির পর একটি মহা দুর্নীতির খবর আসছে। এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, তখন হয়তো আরও নতুন ঘটনা সামনে এসে দাঁড়াবে। খুব ভালো। এ রকম ঘটনা সামনে আসুক, সেটা আমরা চাই। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অভিযান যেন বন্ধ না হয়।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বলেছেন, ‘দুর্নীতি আমাদের সব অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে অফিস-আদালতকে মুক্ত রাখতে হবে।...একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি এমনকি শতকোটি টাকার মালিক হন, তা দেশবাসীকে হতবাক করে। তাই এগুলোকে রোধ করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
দুদক এখন পর্যন্ত বেনজীরসহ বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের যে জমি, শেয়ার, ফ্ল্যাট, ব্যাংক হিসাব ও তার স্থিতি, সঞ্চয়পত্র, বিও হিসাব, পাসপোর্ট খুঁজে পেয়েছে, তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। দু-একটি নমুনা—একজন ডিআইজির বাড়িতে শুধু আসবাবই ৫৬ কোটি টাকা মূল্যের। মতিউর রহমানের প্রতিদিনের মনোরঞ্জনের খরচ লাখ টাকা। সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাসপোর্ট সংখ্যা সাত এবং তাঁর তুরস্ক, পর্তুগাল ও পাপুয়া নিউগিনির পাসপোর্ট রয়েছে। যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা বড় পদের মানুষ।
ঢাকার রাজপথে প্রখর রোদে কৃশকায় বৃদ্ধা তালের পাখা বিক্রি করেন, একজন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধও ভ্যান চালিয়ে দিনাতিপাত করেন, মায়ের চিকিৎসার জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানুষের কাছে হাত পাতেন। এসব তাহলে কে দেখবে?
ভুল চিকিৎসায় ঐশীরা আত্মহত্যা করে, পরিবহনের সীমাহীন বিশৃঙ্খলায় গণমানুষ দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ হাজারো দুর্ভোগ পোহায়, ভেজাল খাদ্যে গোটা জাতির জীবন এবং স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়ে যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির চারবার অনুসন্ধানও ব্যর্থ হয়ে যায়—এসব তাহলে কে ধরবে?
প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় জমির, ফ্ল্যাটের অবৈধ দখল ছাড়াতে বা জমির অন্য কোনো সমস্যা মেটাতে প্রভাবশালী লোকগুলো তার শেয়ারহোল্ডার বা আংশিক মালিক বনে যান। টাকাওয়ালা মানুষের ছেলেমেয়েরা হোটেলে রাত কাটাচ্ছে হয়তো বন্ধু বা বান্ধবীকে নিয়ে।
পুলিশ সেটা ধরে তাদের ছেড়ে দিতে বড় অঙ্কের টাকা নিচ্ছে। পুলিশ অবৈধ পয়সার মালিক হয়ে গড়ে তুলছে ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য। আর যাদের ধরা হলো, তারা সংশোধন হওয়ার বদলে জানল যে টাকা হলেই অন্যায়ের রাস্তা খোলা। তখন তারা সাহস করে অবৈধ কাজ এবং বড় বড় দুর্নীতিতে ঢুকে পড়ছে।
গুণ থাক আর না থাক, রাজনীতির বোধ ও দেশপ্রেম থাক না থাক—আমাদের সরকারি চাকরির অবসর নেওয়া কর্মকর্তা, ক্রিকেট প্লেয়ার, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, ব্যবসায়ীসহ একটু হাতে পয়সা এসেছে অথবা সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছে—তাদের প্রায় সবাইকে এমপি হতে হবে অথবা চাকরি শেষ হওয়ার পরও যেনতেনভাবে আরেকটি কন্ট্রাক্ট নিতে হবে—গভর্নর, কোনো কমিশন বা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বা পরিচালক অথবা নিদেনপক্ষে কোনো ব্যাংকের পরিচালক। এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা! ‘না’ বলার মতো মানসিকতা তো নেই-ই; বরং ‘সব পেতে চাই’-এর লোভ। তারপরও আপত্তি নেই, যদি যোগ্যতা থাকে!
দেখা যাচ্ছে এই কর্মকর্তা নামধারী দুর্বৃত্তদের অনেকেই পিএইচডি হোল্ডার। তাঁদের পিএইচডি ডিগ্রি কেন দরকার? তদুপরি একজন পিএইচডিধারী মানুষ যদি দেশপ্রেমিক ও মানবিক না হন, জ্ঞানপিপাসু না হন, অন্যকে জ্ঞান আহরণে উদ্বুদ্ধ করতে না পারেন—তাহলে তিনি কেন পিএইচডি করবেন? এতে জগতের কী লাভ? কেন তাঁদের এই অনুমতি দেওয়া হয়? এই ডিগ্রিকে ব্যবহার করে তিনি অনেক অনৈতিক সুবিধা নিতে পারেন।