আদিবাসী কোটার বিষয়টি যেন ভুলে না যাই
কোটা নিয়ে আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে এ সময়ে বিসিএসে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সরকারি প্রশাসনে প্রবেশ কঠিন হয়ে যায়। শোনা যায়, গত দুই বছরে মাত্র চার-পাঁচজন বিসিএস ক্যাডার হতে পেরেছেন। ফলে পিছিয়ে থাকা মানে আর এগোতে পারবে না। হাইকোর্টে রিটে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে এর বিরুদ্ধে আবার ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ইতোমধ্যে বাংলা ব্লকেড চলছে। এই আন্দোলনকে সমর্থন করি। আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা অনগ্রসরদের জন্য কোটা রাখার কথা বলেছেন। সরকার তা বিবেচনায় নিলে আমরা স্বস্তি পাব। এর পরিবর্তে পুরো কোটা সিস্টেম বাতিল হওয়া মানে অনগ্রসর জাতির শিক্ষার্থীদের বিপদে পড়া আর কঠিন প্রতিযোগিতায় হাবুডুবু খাওয়া।
কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংবিধানের একটি ধারার কথা আসছে। সংবিধানে ২৯-এর ৩ (ক) উপধারায় বলা হয়, ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ, যা থেকে প্রজাতন্ত্রের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারে, সে উদ্দেশে তাহাদের জন্য অনুকূল বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ মূলত ’৭২ সালে কোটা ব্যবস্থা চালু হয়। সংবিধানে উল্লেখিত সমাজে ‘অনগ্রসর’ অংশ কারা? এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করা হোক। ভারতের মতো দেশে দলিত, অনগ্রসর বিভিন্ন গোষ্ঠীর নামে কোটা ব্যবস্থা চালু আছে। এ দেশে আদিবাসী মোট জনসংখ্যার এক ভাগও হবে না। তাদের অধিকার সীমিত ও জীবন-জীবিকা বৈচিত্র্যময়। অথচ তারা গৌরবোজ্জ্বল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের অধিকারী। সাঁওতালসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এ দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করেছে। পাহাড় ও সমতলে অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা বাংলাদেশের উত্থানকালে নিজেদের উৎসর্গ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও তাদের সাধারণভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা অর্জন হয়নি।
এ জাতিগুলোর পিছিয়ে থাকার কারণ: প্রথমত, ভাষাগত কারণে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকে। তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা চালু করতে পারেনি। প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা শিক্ষক ছাড়া একটি বই বিতরণ করা মানে সরকার এখনও আদিবাসীর শিক্ষাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে স্কুল পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা দুরূহ ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতার পরিবেশ না থাকা। এখনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। ম্রো, খুমি, সাঁওতাল, খ্যাং, মণিপুরি ইত্যাদি জনগোষ্ঠী ইচ্ছা থাকলেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না। কোটায় ভর্তির সুযোগ থাকলেও তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। তার মানে চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা ছাত্ররা কোটার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আরও ছোট জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা টিকতে পারে না। যে শিক্ষার্থী কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, সে কি মেধাতালিকায় বিসিএস পরীক্ষায় এগিয়ে আসবে? এটা বাস্তবতাবিরোধী। সাধারণ প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি।
এ দেশ শুধু বৃহত্তম জাতিসত্তার একক সুবিধার কথা ভেবে গড়ে ওঠেনি। সব জনগোষ্ঠী বা বহুজাতিক সমাজ বা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের কথা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জোরালো আলোচনা হয়েছিল। এ জন্য সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার কথাও উল্লেখ হয়েছে বা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আন্দোলনকারী কর্তৃপক্ষ আর সরকারকে এবার মনোযোগ দিয়ে প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠন করে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
উল্লেখ্য, পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ১৯৯৭ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা হিসেবে নিজস্ব শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে একটি চুক্তি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ চুক্তি সারাবিশ্বে পরিচিতি ও প্রশংসা পেয়েছে। বলা যায়, তিনি এই আদিবাসীদের সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এমনকি তিনি ইতোমধ্যে কোটা ব্যবস্থার পক্ষেও বলেছেন।