বাস্তবতা, বিবেক ও যুক্তির আলোকে কোটাবিরোধী আন্দোলন

যুগান্তর একেএম শাহনাওয়াজ প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৪, ১৩:৪৪

আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অগুনতি। এখন আবার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে বেকারের মিছিলটি আরও বড় হবে। ফলে কর্মসংস্থানের বড় চাপে পড়তে হবে সরকারকে। সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি খুবই জরুরি। কিন্তু নানা ধরনের অপরিকল্পিত নীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনা, তদবির এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতির রাহুগ্রাসে সব সময় প্রকৃত মেধাবীদের অনেকে ছিটকে পড়েন। পদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ প্রকৃত যোগ্য প্রার্থী দিয়ে পূরণ করা হয় কিনা তা নিয়ে ভুক্তভোগী অনেকের সন্দেহ রয়েছে।


চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রথা এ সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানের শাসন অনুসরণ করেন না। নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার প্রয়োজনে শুধু সংবিধানের দোহাই দেন। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে নিতে কোটা সুবিধা দেওয়ার কথা বলা আছে সংবিধানে। সেই হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা সুবিধা দেওয়ার কথা রাষ্ট্র ভেবেছে শুরু থেকেই। এরপর প্রশ্ন চলে আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা দেওয়ার। নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্যও কোটা সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়।


সংবিধানে সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান ন্যায্যতার কথা যুক্ত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশে সরকারি চাকরি প্রার্থীদের প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনায় আনা হয়নি। ঘোষিত পদের ৫৬ ভাগই কোটাভুক্ত করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য, ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য।


সংবিধানের মূল দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় স্বাধীনতার ৪ দশক পর থেকে যৌক্তিক কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি, নারী ও জেলা কোটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও আবেগ রয়েছে সব মানুষেরই। সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদানকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা বয়সের বিচারে চাকরি করায় সক্ষম, তারা তো চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা পেতেই পারেন। পেয়েছেনও। যাদের বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা নেই বা বেঁচে নেই, তাদের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কোটা সুবিধা পাবেন এতে তেমন আপত্তি ছিল না।


কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের সংবিধান মতে, পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর অংশ বিবেচনা করা কি ঠিক হবে? তাছাড়া সুখের কথা আমাদের দেশের মেয়েরা শিক্ষায়, গবেষণায় অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফলাফলের বিচারে অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে স্কুল থেকে সরকার নানা প্রণোদনা দিয়ে আসছে। সুতরাং বর্তমান বাস্তবতায় মেয়েরা প্রতিযোগিতা করে নিজেদের সক্ষমতায়ই চাকরি পাচ্ছে। কোটার অনুগ্রহ তাদের প্রয়োজন পড়ছে না। এটি সম্মানেরও নয়। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট আয়তনের দেশে কেন যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বদলে জেলা কোটা যুক্ত করা হলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়।


নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করা। তবু কৃতজ্ঞ জাতি এটুকু সুবিধা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দিতেই পারে। তাই বলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিরা এটাকে তাদের অধিকার ভাবতে পারেন না এবং যুগ যুগ ধরে এ সুবিধা পেতে পারেন না। এতে দেশের সাধারণ নাগরিক তরুণ-তরুণীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এমন বঞ্চনা সংবিধানসম্মত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের তো স্বার্থবাদী না হয়ে আরও বেশি দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত। তাদের পূর্বপুরুষ যেমন জীবন বাজি রেখে দেশ ও মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তাদেরও উচিত দেশ ও মানুষের কল্যাণ চিন্তা করা; ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটা।


মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গই যদি আসে, তাহলে একটি মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। মিত্র বাহিনীসহ চূড়ান্ত আঘাতের পূর্ব পর্যন্ত দেশজুড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে দুর্বল করে তুলেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। গেরিলা যুদ্ধ একটি সম্মিলিত-সমন্বিত যুদ্ধ। অস্ত্র হাতে যোদ্ধারা এককভাবে গেরিলা যুদ্ধ এগিয়ে নিতে পারেন না। মুক্তিপ্রত্যাশী দেশবাসীর মৌন ও সক্রিয় সহযোগিতায় গেরিলা যুদ্ধ সাফল্য পায়। পাক হানাদার বাহিনীর অগ্নিসংযোগে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। অনেক বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংকল্প দৃঢ় করতে, দেশ-বিদেশে জনমত তৈরিতে এদের অবদান কম নয়।


এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষও নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামে-গঞ্জে যে মা-চাচিরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাত জেগে রান্না করেছেন-খাবার সরবরাহ করেছেন, যে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়েছেন, পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের অস্ত্র নিরাপদে লুকিয়ে রেখেছেন-তাদের কি মুক্তিযোদ্ধার তালিকার বাইরে রাখা যায়? আমি নিজের কথাই বলি, নারায়ণগঞ্জের বন্দরে আমাদের তিন পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তি ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা জামায়াতে ইসলামীর লোকজন ও বিহারিদের সহযোগিতায়। পরিবার আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক হওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ক্লাবের তরুণদের মার্চপাস্টে সাহায্য করার অপরাধে আমাদের মতো অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি কি এর বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা দাবি করেছে? নাকি সরকার কোনো স্বীকৃতি দিয়েছে? বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে তাদের অনেকের সম্পদ ও জীবন গিয়েছে। এমন অসংখ্য বাঙালির সার্বিক সহযোগিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য লাভ সহজ হয়েছিল।


আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই স্বাভাবিক নিয়মে এখন আর বেঁচে নেই। অনেকে বয়োবৃদ্ধ হয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তারা সচেতনভাবে সার্টিফিকেটও নেননি। আমি প্রয়াত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে জানি, যারা বলতেন, ‘সার্টিফিকেটের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমি যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তা প্রচার করার প্রয়োজন মনে করি না।’ মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে বৈষয়িক সুবিধা পেতে চাননি অনেকেই। তারা জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। আমি নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বড় অধ্যায়টিই হলো, বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা লেখানো। তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। অনেককে দেখেছি তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং চাকরির কোটা সুবিধা না নেওয়ার জন্য উপদেশ দিতে। তাদের মতে, অমনটি হলে মুক্তিযুদ্ধটা বিনিময়ের বিষয় হয়ে যাবে!

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও