তিস্তা প্রকল্পটি হোক বহুপক্ষীয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, সেদিক থেকেও এ সফর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি শুধু ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই চুক্তি করেছেন এমন নয়; বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর ঘিরে তিস্তা বিশেষ আলোচনায় এসেছে।
বস্তুত তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময়ে। চুক্তিটি হচ্ছে না, কারণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতা করেছেন। একদিকে তিনি বিরোধী দলে, অন্যদিকে তাঁর রাজ্যের পানিসম্পদেরও ব্যাপার। যে কারণে চুক্তিটি এগোচ্ছে না। তবে এবার তিস্তা বাঁধের বাংলাদেশ অংশে জলাধার নির্মাণ করে বর্ষায় পানি সংরক্ষণ করে শীতের সময়ে ব্যবহারের যে প্রস্তাব চীন দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নদী খনন, নদী শাসন কিংবা অন্যান্য বাঁধের বিষয়ও রয়েছে।
চীন পুরো বিষয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাইয়ের কথা বলেছে। তবে এখনও ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়নি। ইতোমধ্যে ভারতও তাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখানে ভারতের একটি দল এসে তা বাস্তবায়নে কী করা যায়, সেটা দেখবে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেখানে জলাধার নির্মাণ বা যাই করি, তা করতে গেলেও ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা লাগবে। কারণ আমরা ভাটির দেশ। সে জন্য কোন সময় কত পানি পাব, তার ওপর নির্ভর করেই পরিকল্পনা এগোতে হবে।
আমি মনে করি, যেহেতু এটি অনেক বড় প্রকল্প হবে, সে জন্য ভারত কিংবা চীনের বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশকে আমরা এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যেসব দেশের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে, যেমন নেদারল্যান্ডস বা জার্মানি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ যদি এগিয়ে আসতে চায়, তাদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে গঙ্গা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ২০২৬ সালে এ চুক্তির ৩০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তখন উভয় দেশ আবার এ নিয়ে আলোচনা করবে। তবে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আমার দুটি পর্যবেক্ষণ আছে। আমরা যখন চুক্তিটি স্বাক্ষর করি, তখন ভারতে কোয়ালিশন সরকার। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ। তা ছাড়া জ্যোতি বসুরও বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ সমর্থন ছিল। এখন ৩০ বছর পর নবায়ন আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী বলে নরেন্দ্র মোদি চাইলেই যে সব করতে পারবেন, তা নয়। তা ছাড়া এই ৩০ বছরে আমরা গঙ্গা চুক্তি অনুসারে সেভাবে কাজ করিনি। সে জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে পারেন, আপনারা তো এ সময়ে চুক্তিকে কাজে লাগাননি। সে জন্যই কঠিন দরকষাকষির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ ও বিহারও তাতে ভেটো দিতে পারে। সে জন্য আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই।
এ সফরের আলোচনায় রেল ট্রানজিটের বিষয়ও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সম্প্রতি যে ১০টি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে রেল ট্রানজিট। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশে ভারতের ট্রেন চললে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। অথচ সাত-আট বছর ধরে ঢাকা থেকে কলকাতা এক দিন বাংলাদেশের ট্রেন, আরেক দিন ভারতের ট্রেন চলছে। খুলনা থেকেও চলছে। এখন নতুন করে রাজশাহী থেকে ভারতের ট্রেন চললে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে কীভাবে! মনে রাখতে হবে, বিশ্বে বর্তমান সময়ে কানেক্টিভিটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম যখন আগরতলা থেকে ঢাকায় বাস সার্ভিস চালু হয় তখনও দেশ-জাতি গেল বলে অনেকে সুর তোলেন। এখন তো নিয়মিতই বাস চলছে, তাতে সমস্যা হচ্ছে না।
আমরা দেখছি, ঢাকা থেকে যে ট্রেন ভারত যায়, তার অধিকাংশ যাত্রীই বাংলাদেশের। কম খরচে যাওয়ার সুবিধা তারা ট্রেনের মাধ্যমে পাচ্ছে। রেল ট্রানজিটের যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী ভারতীয় পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেন বাংলাদেশের রেললাইন ব্যবহার করে কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি যাবে বা কলকাতা থেকে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে আগরতলা যাবে এবং একইভাবে ফিরে আসবে। এটা চুক্তি হয়েছে মাত্র। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে– প্রতি টন বা যাত্রীপ্রতি কত টাকা পাবে বাংলাদেশ। এটা যেন আমাদের জন্য সুবিধাজনক হয়। তার তথ্যও সবাই জানবে। এখানে উভয়ের জন্য ‘উইন উইন’ তথা লাভজনক অবস্থা থাকা দরকার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- তিস্তা পানি চুক্তি