প্রত্যাশা পূরণে পিছিয়ে
গেল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। শুরুতে পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় অনেক প্রত্যাশা ও সম্ভাব্য প্রাপ্তির কথা বলা হলেও বিদায়ি অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে আগামী বাজেটের বিশেষ পার্থক্য লক্ষণীয় নয়। এমনকি খাতওয়ারি বরাদ্দেও বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির বড় দুটি চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়নে বরাদ্দে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
বাজেটে প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর কমানো হলেও ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। তবে ব্যক্তির আয়কর স্ল্যাবে কিছুটা পরিবর্তন আনায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের করদাতাদের মনে হয়তো সামান্য স্বস্তি আসবে। তবে এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে ব্যক্তির আরও ব্যয়যোগ্য আয় বাড়ানোতে মনোযোগ দিলে ভালো হতো। বিকাশমান অর্থনীতিতে ব্যক্তির, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অনেক সুফল দেয়।
বাজেটের অনেক ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা এটাও স্বীকার করি-কিছু জায়গায় কর বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করার জন্য যে উদ্ভাবনী ও কার্যকর উপায় খোঁজার প্রয়োজন ছিল, বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা সে ব্যাপারে ভেতরে ঢুকতে চাননি।
অনেকেই বলছেন, এবারের বাজেটে কর খাতটির পরিকল্পনা আরও ভালো হতে পারত। আমাদের দেশে কর-সক্ষম অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই কর দেয় না। তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এবারের বাজেটেও উপেক্ষিত। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসত। এক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো সংস্কার কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ৩৭.৫ লাখ টাকার উপর আয়ের লোকদের ৩০ শতাংশ হারে করের বিধান থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে। ছায়া অর্থনীতিকে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য এটি অনেক জায়গাতেই কাজ দিলেও এ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়।
বাজেটের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো সরকারের পরিচালন ব্যয়। এ বাজেটেও পরিচালন ব্যয় একটা বড় অংশ। উন্নয়ন ব্যয় যদি ৩৬ শতাংশ হয়, তাহলে পরিচালন ব্যয় ৬৪ শতাংশ।
বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকে জনপ্রশাসন খাতে। অতীতের মতো এবারও খাতটিতে ২২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আমরা জানি, তৃণমূল পর্যায়ে দায়িত্বশীলভাবে উন্নয়ন ব্যয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গায় উন্নয়ন ব্যয় খাতে যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
কিছুটা হলেও এবার সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালন ব্যয়ে বেশকিছু জায়গায় কাটছাঁট করার সুযোগ ছিল। কৃচ্ছ্রতার স্লোগান সত্ত্বেও বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে এবার সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি কেন-এ প্রশ্ন এসে যাবে।
সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধে বড় ধরনের একটা ব্যয় থাকে। এবার সেটা ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এ জায়গায় যখন এত বড় ব্যয় করতে হচ্ছে, তখন রাষ্ট্রের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন মেটানোতে চাপ তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতে এসব ব্যয়ের প্রভাব পড়ছে।
দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ঋণের বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসছে। ঋণ আমাদের কোনো সমাধান দিতে পারে না। বরং ঋণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমরা সমস্যা জিইয়ে রাখছি। যদি অভ্যন্তরীণ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোটা অঙ্কের ঋণ এবং টাকা ছাপানো মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়ে সাধারণ লোকের জীবন দুর্বিষহ করে দিতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সামান্য বাড়িয়েও এ থেকে মুক্তি মিলবে না।