মুখ থুবড়ে পড়া গণতন্ত্রকে দাঁড় করানো প্রয়োজন
হুমকিধমকি দিয়ে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করে হয়তো অনেক তাৎক্ষণিক লাভ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ইতিহাসকে নির্বৃত্ত করা যায় না। সত্যের কাছে পৌঁছার জন্য ইতিহাসের থাকে অনন্ত প্রচেষ্টা। কিছু সময় হয়তো মানুষকে ভুলের আবর্তে রাখা যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য বেরিয়েই আসে। রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙতে ভাঙতে এখন শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
গণতন্ত্র নামে যা এখন প্রকাশ্য, তা এক রকম গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা। অথবা বলা যায়, গণতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে বা গণতন্ত্রের চাদর মুড়িয়ে স্বেচ্ছাতন্ত্রের শক্তিমান হওয়া। দুর্নীতি প্রতিপালন করে গণতন্ত্রের পরিচর্যা সম্ভব নয়। এ দেশে বিভিন্ন শাসনপর্বে গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাতন্ত্র এমন জেঁকে বসেছে যে, গণতান্ত্রিক আচরণ অলীক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র এখন আটকে আছে নির্বাচনি খাঁচায়। তাও নির্ভেজাল থাকেনি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত। কিন্তু তেমনটি কার্যত দেখা যায়নি। নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং নানা কৌশলে নির্বাচন গড়াপেটার মধ্য দিয়ে ফলাফল শক্তিমানের পক্ষে আনাকে আর যা হোক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রকাশ বলা যায় না।
অনেক আগে থেকেই জাল ভোটার তালিকা, নির্বাচনে টাকা ও শক্তির জোরে ভোট কেনা, জাল ভোটে ব্যালট বাক্স ভরা, এসবের বাস্তবতায় মানুষ নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর ফল আমরা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং চলমান উপজেলা নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করছি। নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে মানুষ আর ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। এর সুবিধা নিচ্ছে বিএনপি। বলছে তাদের নির্বাচন বর্জনের ডাকে মানুষ সাড়া দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, মানুষ এমনিতেই আগ্রহ হারিয়েছে। বিএনপির কৃতিত্ব নেওয়ার কিছু নেই। বরং বিএনপি নানা ছুতোনাতায় নির্বাচন বর্জন করে যাচ্ছে। এটিও গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিএনপির মতো একটি বড় দল গণতান্ত্রিক দায়িত্ব মেনে যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ আছে বলে ভোটারের প্রাণচাঞ্চল্য অনেক বেশি দেখা যেত। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রচর্চা করা প্রাচীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নেতারাই তো বলেছিলেন ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’। এভাবে গণতান্ত্রিক আচরণ থেকে আওয়ামী লীগই যখন দূরে সরে গেছে, সেখানে বিএনপির কাছ থেকে গণতন্ত্রচর্চা আশা করব কেন? সব নির্বাচনের আগেই ভীতি পেয়ে বসে বিএনপি নেতাদের মাথায়। এদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনি যুদ্ধের মাঠে সক্রিয় থেকেই এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অভিমান দেখলে মনে হয়, তাদের জেতার নিশ্চয়তা দিলেই তারা নির্বাচনে আসবে। তাই বলতে হবে, নির্বাচনি ব্যবস্থা নষ্ট করার পেছনে বিএনপির দায়ও কম নয়।
এসব কারণেই বলা যায়, গণতন্ত্র শক্তভাবে দাঁড়াতে না পারার পেছনে রয়েছে আমাদের ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা দলগুলোর ব্যর্থতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙার অপরাধে ইতিহাস তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। কঠিন দলতন্ত্রে আটকে থাকায় এবং সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির চারণভূমিতে পরিণত করায় এখন আর সম্ভব নয় গণতন্ত্রের পরিচর্যা করা। তাই বলা যায়, ক্ষমতাপ্রত্যাশী বর্তমান রাজনীতিকদের হাতে গণতন্ত্রের অগ্যস্তযাত্রাই হয়ে গেল! অথচ এ দেশে গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন।