মন্ত্রী-এমপির স্বজন তোষণ: রোগ নয় উপসর্গ
বিএনপি ও তার মিত্রদের বর্জনের মুখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন একেবারেই নিরুত্তাপ হয়ে পড়ছিল, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় নিয়ন্ত্রণ খানিকটা শিথিল করে দলের মনোনয়নবঞ্চিতদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দেয়। এ ব্যবস্থা নির্বাচনের ধ্রুপদি সংজ্ঞাসম্মত নয় বলে এর বিরুদ্ধে অনেকে সমালোচনামুখর হলেও, সাধারণ ভোটারদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি।
এ ধারণা অমূলক নয়, নির্বাচনে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে যে তিন হাজারের বেশি নেতা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন; স্বতন্ত্র প্রার্থিতার পক্ষে সময়মতো সিদ্ধান্ত এলে তাদের বড় অংশ সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করত। এতে নির্বাচনটি আরও জমজমাট হতো। আর কিছু না হোক, এর ফলে দুই দফা একতরফা জাতীয় নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের মৌরসিপাট্টা খানিকটা ঝাঁকুনি খেত। হয়তো এ প্রক্রিয়ায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বও ভোটারদের প্রকৃত মনোভাব আঁচ করতে পারতেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, কেউ যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার সাধ না করে। কিন্তু বহু নেতা নিজেদের আসনে ঢাল-তলোয়ারবিহীন ‘ডামি’ প্রার্থী রেখে নানা অপকৌশল প্রয়োগ করে অন্যদের বসিয়ে দিয়ে এক প্রকার সাজানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। উপরন্তু নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগের দিনও আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন; তাদের পক্ষাবলম্বনকারী নেতাকর্মীকে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। এসব কারণে দেখা গেছে, সরকারদলীয় বহু নেতা উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও নির্দিষ্ট দিনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। শুধু খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের অবাধ প্রচারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন, তখন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনে একটু বল পান। অবশ্য এত কিছুর পরও আমরা দেখেছি, প্রায় ১০০ আসনে নৌকা ও কথিত বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে জোরদার লড়াই হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের বহু আপাত-অপরাজেয় এমপির সর্বনাশ ঘটিয়ে নজিরবিহীনভাবে ৬২ জন স্বতন্ত্র এমপি পাস করেন।
ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনের গা-ছাড়া ভাবের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনে ক্ষমতাসীন এমপিদের প্রভাব থাকার পরও একযোগে এতজন নতুন এমপির উত্থান সম্ভবত সরকারপ্রধানকেও চমৎকৃত করেছে। না হলে, একই রেসিপি তিনি চলমান উপজেলা নির্বাচনেও প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন না। লক্ষণীয়, এবার বেশ আগেভাগেই তিনি দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে নির্বাচনকে আক্ষরিক অর্থেই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন জামানতের টাকা কয়েক গুণ ধার্য করলেও, বিশেষত নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটারের সমর্থনসহ মনোনয়নপত্র জমাদানের শর্ত তুলে দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ অবারিত করেছে। নিঃসন্দেহে এসব সিদ্ধান্ত একটা অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় নির্বাচনের জন্য সহায়ক। এমন পরিবেশে প্রতিটি উপজেলায় একাধিক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে নামার কথা। এতে ভোটাররাও পছন্দের নেতা বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু অন্তত প্রথম দুই ধাপের পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, সে আশা আপাতত তিরোহিত।
সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রথম ধাপের ১৫০ উপজেলার মধ্যে অন্তত ৩৩টিতে স্থানীয় এমপির স্বজন চেয়ারম্যান পদে হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন অথবা সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এর বাইরে ‘মাইম্যান’ বলে পরিচিত বিভিন্ন স্থানে এমপির একান্ত অনুগত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের হিসাবে নিলে প্রথম দু’দফার নির্বাচনে বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন উপজেলার সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।
উল্লেখ্য, সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ইতোমধ্যে একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন, দলীয়প্রধান মন্ত্রী-এমপির স্বজনকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে নির্দেশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপির কাছে পৌঁছেও দেওয়া হয়েছে। তার পরও প্রথম দু’দফার নির্বাচনে পরিস্থিতির তেমন ইতরবিশেষ ঘটেনি।