এমন আত্মহত্যায় কি সংকট মিটবে?
যুক্তরাষ্ট্রের মদদে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর চলমান নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে ২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেল নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। দিনটি ছিল রোববার। ইসরাইলি দূতাবাস ছিল বন্ধ। লোকজনের আনাগোনাও ছিল কম। অনেকটা নিরিবিলি পরিবেশে এ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। বুশনেল যখন নিজের গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন, তখন লাইভ ভিডিওতে তার কথা ও দৃশ্যাবলি ধারণ করা হয়েছিল। আত্মহত্যার সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে বুশনেলকে বলতে শোনা যায়, এ গণহত্যায় তিনি নিজেকে আর জড়াতে চান না। এ কারণে প্রতিবাদের চরম ভাষা হিসাবে এ পথ তিনি বেছে নিয়েছেন। তবে উপনিবেশকারীদের (ইসরাইলি) হাতে ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত যে যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন, সে তুলনায় তার এ যন্ত্রণা কিছুই না। নিজের দেহে আগুন দেওয়ার পর যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিলেন, তখন তাকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করো।’ এর পরপরই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরদিন হাসপাতালে যখন বুশনেলের মৃত্যু হয়, তখনো গাজায় চলছিল ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। গত অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের দূতাবাসের সামনে একের পর এক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনপন্থি দুপক্ষই সেখানে বিক্ষোভ করেছেন। তবে বুশনেল গায়ে আগুন লাগিয়ে যে আত্মহত্যা করেছেন, এমন তীব্র প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেনি। ২০২০ সালে অ্যারন বুশনেল একজন সাইবার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে মার্কিন বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বিমানবাহিনীর ৭০তম গোয়েন্দা, নজরদারি ও অনুসন্ধান শাখায় কর্মরত ছিলেন।
ফিলিস্তিনের গাজায় ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর, এখন পর্যন্ত ইসরাইলি বর্বর বাহিনী অন্তত ৩০ হাজার ৩৫ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন ৭০ হাজার ৪৫৭। নিহত পুরুষ ছাড়াও ২৫ হাজারের বেশি নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এছাড়া ৩৪০ জন চিকিৎসাকর্মী ও ১৩২ জন সাংবাদিককেও হত্যা করা হয়। ইসরাইলের গণহত্যার যে পরিসংখ্যান দেওয়া হলো, তা হামাসের দেওয়া কোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, এটি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিুকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের হাউজ আর্মড সার্ভিসেস কমিটির এক শুনানিতে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন সে দেশের আইনপ্রণেতাদের এ তথ্য দেন। নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হবে মনে করা হচ্ছে। কারণ, হাসপাতালে আসা মরদেহ হিসাব করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিহতদের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তারই ওপর ভিত্তি করে এ তথ্য জানানো হয়। এখানে ইসরাইলের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার ধ্বংস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা আরও হাজার হাজার মরদেহ এ হিসাবে ধরা হয়নি।
গাজাবাসীর ওপর নৃশংসতার আরও একটি নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসরাইল। তাদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, পেটের দায়ে খাদ্যের সন্ধানে থাকা মানুষও পরিত্রাণ পাচ্ছে না। এতদিন গাজাবাসীদের বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস-আদালত, বাজারঘাট ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েও তারা শান্ত হচ্ছে না। ২৯ ফেব্রুয়ারি খাদ্যের অভাবে ত্রাণ নিতে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের ওপরও তারা বিমান হামলা ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে সাড়ে আট শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হতাহত করেছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১১২ জন নিহত হয়েছেন। অবরুদ্ধ গাজায় বর্তমানে এক-চতুর্থাংশ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে আছে। উত্তরাঞ্চলে দুই বছরের কম বয়সি প্রতি ছয় শিশুর একজন মারাত্মক অপুষ্টিত ভুগছে। হাসপাতালগুলোতে পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ওই অঞ্চলে নিয়মিত ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাই ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই ক্ষুধার্ত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ২৯ ফেব্রুয়ারি ভোরেও গাজানগরীর দক্ষিণে আল-রশিদ সড়কে ত্রাণের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন হাজারও ক্ষুধার্ত মানুষ। ত্রাণের গাড়ি আসা শুরু হলে ছুটে যান তারা। এ সময় ত্রাণের জন্য মরিয়া এ ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর বিমান হামলা ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে হত্যাকাণ্ড চালায় ইসরাইলি বাহিনী। হামলা চালানোর পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা আহত ও মৃতদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে ট্যাংক চালিয়ে ইসরাইল পৈশাচিকতার চরম রূপ দেখিয়েছে বিশ্ববাসীকে।