স্বাধীন ও স্বাধীনতা
এখনো কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন—স্বাধীনতা মানে কী, আর মানুষইবা কতটা স্বাধীন? উত্তরে কেউ বলেন, স্বাধীনতা মানে ইচ্ছেমতো কাজ করা। অথচ মানুষ ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে না। মানুষকে বাধা দেওয়া হয়, আটক করা হয়। ফলে তাদের দৃষ্টিতে অনেকেই স্বাধীন নয়, কেউ কেউ স্বাধীন। কেউবা গম্ভীর হয়ে বলেন, স্বাধীনতা হলো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সব অধিকার ভোগ করা। একজন নাগরিক রাষ্ট্রের বিধি অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, এটাই তার স্বাধীনতা।
আর এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবতারণা। তৎকালীন পাকিস্তানের পরাধীনতার শিকল ভেঙে, অধীনস্থবাদের নাগপাশ ছিন্ন করে বাঙালি জাতি প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জন করে। এই লড়াই ছিল মর্যাদার, অধিকার ভোগ করার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে নিরস্ত্র বাঙালি স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরাধীনতা থেকে মুক্তির নেশা এতটাই প্রকট ছিল যে, মাত্র ৯ মাসে এই দেশ শত্রুমুক্ত হয়। এই স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতি হারিয়েছে লাখ লাখ তাজা প্রাণ, লাখো নারীর সতীত্ব। হারাতে হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের।
কেউ কেউ বলে বসেন, পাকিস্তান আমলে তারা ভালো ছিলেন। অথচ বাংলাদেশের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে অনেকের চাইতে তারা ভালো থাকেন। এই সুবিধাবাদী শ্রেণি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে প্রাদেশিক ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন থাকে। এরা পোশাকে বাংলাদেশি অথচ চেতনায় পাকিস্তানি। স্বাধীনতাবিরোধী এই শ্রেণি সমাজের প্রতিটি স্তরে অবস্থান করে দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখার পাঁয়তারা করে। আর স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে ভিন্নার্থে উপস্থাপন করে চলে। এদের কাছে স্বাধীনতা মানেই হলো স্বেচ্ছাচারিতা। নতুন প্রজন্মের কাছে এরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়।
যা ইচ্ছে তাই করা, যা ইচ্ছে তাই বলার ব্যক্তিরা মনে করে এটাই তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা। তারা ভুলে যায় যে, ব্যক্তি স্বাধীনতাও সংবিধানসম্মত হতে হয়। সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বা রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, এমন কোনো কিছু ব্যক্তি চাইলেই করতে পারে না। করার চেষ্টা করলে সেটা হবে আইনত অপরাধ। সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানে আইন প্রণয়ন করা হয়। সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ব্যক্তিকে আইন অনুযায়ী আচরণ করতে হয়। একজন ব্যক্তি চাইলেই এমন কিছু বলতে ও করতে পারে না, যা দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। উপরন্তু দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হয়।
বাক্স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অনেকেই এমন অনেক কথা বলে, যা দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় না। আবার যৌক্তিক কথা বলতে অনেকেই বাধাগ্রস্ত হয়। তাকে হেনস্তাও করা হয়। হয়রানি চলে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত ঘটে রাজনৈতিক ইস্যুতে। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি ব্যক্তির ভেতর থেকে সততা ও স্বচ্ছতা যেমন গ্রাস করে, তেমন উপযুক্ত ও যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে নির্মূল করে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার ঘটনা ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহান স্বাধীনতাকে দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা হয়, বিশ্লেষণ করা হয়। স্বাধীনতার বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছায় না। শ্রদ্ধার এক কাতারে দাঁড়ায় না। উপরন্তু, স্বাধীনতার ইস্যুতেও রাজনীতি বিভাজনের রেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানতে পারে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্বাধীনতা অর্জন