বিদায় ২০২৩: ক্ষয়ে যাওয়া দিন ভরে রইল প্রাপ্তিতে
সময়ের বৃক্ষ থেকে আরও একটি পত্র ঝরে যাবে এক দিনের মধ্যেই, যবনিকাপাত হবে ২০২৩ সালের। শুরু হবে নতুন বছর, ২০২৪। পৃথিবীর ও বৃহত্তর মানবজীবনের পথপরিক্রমায় ৩৬৫ দিন নিশ্চিতভাবে পরমাণুসম ক্ষুদ্র, একটি দেশ বা সমাজের সার্বিক বিবর্তনেও একটি বছর তেমন কিছু নয়, একজন ব্যক্তিমানুষের পুরো জীবনবলয়েও হয়তো একটি বছরের সামগ্রিক গুরুত্ব তেমন একটা বড় নয়, তবু প্রতিটি বছরই তার নিজস্ব তাৎপর্যে ভাস্বর যেমন পুরো পৃথিবীর জন্য, তেমনি একটি দেশ বা সমাজের জন্য এবং সেই সঙ্গে একজন ব্যক্তিমানুষের জন্য।
এই যে ১৯৬৯ সাল। মানুষ প্রথম চাঁদে পা রাখল—ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে গেল সারা পৃথিবী আর মানবসভ্যতার জন্য। আর কোনো বছর এই অভূতপূর্ব অর্জনের ওপরে দাবি রাখতে পারবে না–ওটা শুধু ১৯৬৯-এর। তেমনি ১৯৮৯–বার্লিন দেয়ালের পতন। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি মিলে অখণ্ড জার্মানি হয়ে গেল। অন্য কোনো বছর চিহ্নিত হবে না এ অভাবিত ঘটনার জন্য–ওটা ১৯৮৯-এর। তেমনি প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের জীবনেও কোনো কোনো বছর হিরণ্ময় স্মৃতি হয়ে থাকে– সুখের কারণে অথবা ধূসর পর্দা হয়ে থাকে–‘পাতার নিচে, ছাতার মতো’ পরম ব্যাপ্ত দুঃখময় স্মৃতির কারণে।
প্রায়ই বহু মানুষকে বছরের শেষে বলতে শুনি, ‘হায়, আরও একটা বছর ঝরে গেল জীবন থেকে’। এই উক্তির সঙ্গে বেরিয়ে আসে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। কেউ কেউ আবার এমনও বলেন, ‘মৃত্যুর দিকে আরও এক পা এগোলাম’। এসব মানুষের জন্য চলে যাওয়া বছর একটি ক্ষয়।
আমার জন্য শেষ হয়ে যাওয়া বছর একটি প্রাপ্তি। আমি ভাবি, ‘জীবন ভারী সুন্দর। ভাগ্যিস, বিগত বছরটা পেয়েছিলাম জীবনে। নইলে এত সব নতুন মানুষের দেখা পেতাম কি আমার জীবনে। নতুন করে জানা হতো কি পুরোনো মানুষদের। যেতে পারতাম কি নতুন নতুন জায়গায়। জানতে পারতাম কি, যা ছিল অজানা? কতটা দিয়ে গেল আমাকে পুরোনো বছরটা!’
শেষ হয়ে এল ২০২৩। পৃথিবীতে কত বদল হয়েছে এ বছরে, ঘটেছে কত পরিবর্তন নানান দেশে, সমাজে। ওই সব পরিবর্তন নিয়ে অনেকের মতো ভাবি, ব্যাখ্যা খুঁজি, জানি যে এসবের প্রভাব আমার জীবনেও পড়বে। কিন্তু বাইরের বৃহত্তর পৃথিবীর পরিবর্তনে যতটা আন্দোলিত হই, ততটাই হই আমার নিজস্ব পৃথিবীর বদলে।
এর কারণ হয়তো নানাবিধ—বাইরের পৃথিবীর পরিবর্তন যেমন অনেক সময় নৈর্ব্যক্তিক দূরের জিনিস বলে মনে হয়, আমার পৃথিবীর বদলগুলোও আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে বাস্তব বিষয় বলে মনে হয়; বাইরের পৃথিবীর ঘটনাগুলো বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে অনুধাবন করতে পারি, আমার পৃথিবীর জিনিসগুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। তাই যেকোনো বছরকে আমি যেমনি দেখি বাইরের বৃহত্তর জগতের পরিপ্রেক্ষিতে, তেমনি দেখি আমার পৃথিবীর আরশিতে।
বাইরের বৃহত্তর জগতের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের বিশ্বের দিকে যখন তাকাই, তখন পাঁচটি কথা আমার মনে হয়। এক. গত কয় বছরের কোভিড অতিমারির পরে ২০২৩ সালকে আমার মনে হয়েছে একটি স্বাভাবিক বছর। ২০২২ সালেও মানুষের কোভিড-উদ্বিগ্নতা পুরোপুরি কেটেছিল বলে আমার মনে হয়নি। ২০২৩ সালে পৃথিবী অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। যদিও এর মধ্যে পৃথিবীর ওলট-পালট হয়েছে হয়েছে জীবনযাত্রায়, অর্থনীতিতে, আমার বোধ-উপলব্ধিতে। না, ওই পুরোনো পৃথিবী আমরা আর ফিরে পাব না, কিন্তু গত কয় বছরের অস্থির পৃথিবী অনেকটাই স্থির হয়ে এসেছে। ২০২৪ সালের শুরুতেই প্রার্থনা করি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন এমন সময় পার করতে না হয়।