হলফনামা যেন নিতান্তই এক আনুষ্ঠানিকতা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী প্রদত্ত হলফনামার ভিত্তিতে আমরা প্রতিনিয়ত অনেক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখছি। হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের অসংগতির ভিত্তিতে তৈরি এসব প্রতিবেদনের ওপর পাঠকের সব মন্তব্যই নেতিবাচক। আমাদের আশঙ্কা, যে উদ্দেশ্যে আদালত কর্তৃক হলফনামার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা আজ যেন নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। কারণ, তথ্য গোপনের কারণে হলফনামা ভোটারদের সামনে প্রার্থীদের সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এবং তাদের ‘ইনফমর্ড ডিসিশন’ নিতে সহায়তা করতে পারছে না।
প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়ের উৎস, নিজেদের এবং নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়-দেনার তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো, ভোটারদের ক্ষমতায়িত করা, যাতে তারা ভোটকেন্দ্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভোটারদের এ ধরনের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মতে: ‘... নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানে। তাদের ‘এ’ কিংবা ‘বি’-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র এবং উপহাসে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ [পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪এসসিসি]। তাই হলফনামা প্রার্থীদের জন্য আমলনামার মতো কাজ করার কথা। কারণ, তথ্য গোপনের জন্য মনোনয়নপত্র, এমনকি নির্বাচন বাতিল হওয়ার বিধান আইনে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালে আমাদের উচ্চ আদালতে আবদুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ মামলার (রিট পিটিশন নম্বর ২৫৬১/২০০৫) রায়ে প্রায় একই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করা হয়। রায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া আদালত হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
কিন্তু উপরোক্ত রায়কে ভন্ডুল করার লক্ষ্যে আবু সাফা নামে এক দুর্বৃত্তের মাধ্যমে জালিয়াতি করে সম্পূর্ণ গোপনে আপিল করা হয়। মামলার মূল বাদীদের আপিলের ব্যাপারে নোটিশ দেওয়া হয়নি; নির্বাচন কমিশনকেও জানানো হয়নি। আপিলকারী ছিলেন একজন তৃতীয় পক্ষ; তৃতীয় পক্ষকে সাধারণত আপিল করতে দেওয়া হয় না। তৎসত্ত্বেও শুনানিতে মূল মামলার বাদীদের অনপুস্থিতিতেই লিভ টু আপিল একতরফাভাবে গৃহীত হয়। এ খবর শোনার পর মূল বাদীদের পক্ষ থেকে ‘কেভিয়েট’ দেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী শুনানি তাদের অনপুস্থিতিতে না হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মাত্র দু’দিন আগে, আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি জয়নুল আবেদীন আবারও একতরফা শুনানির ভিত্তিতে হলফনামা প্রদানের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। ফলে ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলফনামা ছাড়াই মনোনয়নপত্র জমা দেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- হলফনামা
- নির্বাচনে প্রার্থী