ধনীরাই মূলত দায়ী
সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনের ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠেছি। বলে কী! পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নাকি মূলত অভিজাত শ্রেণির ধনীরাই দায়ী! তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘অভিজাত দূষণকারী’ (দ্য পলিউটার এলিট) হিসেবে। অক্সফামের একটি গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সেই পত্রিকা লিখেছে, পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ অতিধনী শ্রেণির। এসব লোকের অতিবিলাসী জীবনযাপন, যেমন—যানবাহন ও শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবহারে বিগত ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে মোট ৫.৯ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসারণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি একটি সূত্র বা ফর্মুলা ব্যবহার করে হিসাব কষে দেখেছে যে প্রতিবছর প্রতি মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসারণের জন্য বিশ্বে অতিরিক্ত ২২৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। এতে কত মানুষ যে অসুস্থ হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। এভাবে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসারিত না হলে সেই সব মানুষের হয়তো মৃত্যু হতো না।
তাদের অনুমান, এই ১ শতাংশ মানুষের ভোগবিলাসী জীবনযাপনের কারণে হয়তো এই দশকে পৃথিবীতে ১.৩ মিলিয়ন লোক মারা যাবে তাপের আধিক্য বা গরমের কারণে।
গবেষকেরা বলছেন, এই অতিধনীরা বিগত ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট যে পরিমাণ কার্বন নিঃসারণ করেছে, তার পরিমাণ গত বছর বিশ্বের ৬৬ শতাংশ গরিব মানুষ যে পরিমাণ জ্বালানি পুড়িয়েছে তার সমান। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের মোট গম উৎপাদন, ইউরোপে মোট ভুট্টা উৎপাদন ও বাংলাদেশে ধান উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসারিত হয়েছে, এর পরিমাণ প্রায় তার সমতুল্য। জাতিসংঘ বলছে, প্রতিবছর চরম বৈরী আবহাওয়ার কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ৯১ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো।
ধনী কারা, তারও একটা মাপকাঠি গবেষকেরা ঠিক করে নিয়েছেন। তাঁদের মতে, বছরে যাঁরা মাথাপিছু ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার বা ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ ইউরো খরচ করে, তারা হলো অভিজাত ধনিক শ্রেণি। এই অভিজাত দলে বিশ্বব্যাপী রয়েছে প্রায় ৭৭ মিলিয়ন মানুষ, যাদের মধ্যে বহু মিলিয়নিয়ার- বিলিয়নিয়ার রয়েছে। তারাই ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন নিঃসারণের মধ্যে ১৬ শতাংশ নিঃসারণের জন্য দায়ী বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরূপ একজন অভিজাত ধনী লোক এক বছরে যে পরিমাণ দূষণ ও কার্বন নিঃসারণ করছে, যেসব মানুষ একেবারে নিচের দিকে আছে, অর্থাৎ অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে একজনের জন্য সেই পরিমাণ কার্বন নিঃসারণ করতে প্রায় ১ হাজর ৫০০ বছর সময় লাগবে। জলবায়ু ও ধনী-দরিদ্রের আচরণের এই অসমতা একে অপরের পরিপূরক। পৃথিবীতে ধনীদের সংখ্যা বাড়লে জলবায়ু পরিবর্তন আরও দ্রুত হবে, জলবায়ুর সংকট বাড়বে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা কল্পিতভাবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রত্যাশিত মাত্রায় বেঁধে রাখার যে সীমা নির্ধারণ করেছি, বাস্তবে সেভাবে তা ঘটবে না। কোনোভাবেই আমরা হয়তো এই সময়ের মধ্যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রাকশিল্প যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে পারব না। এটা অনেকটা গাণিতিক সূত্রের মতো অবধারিত সত্য।