কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘মহেশ’। সেখানে আমরা দেখেছি, গ্রামের জমিদার ও পুরোহিতদের অত্যাচারে গরিব চাষী গফুর মেয়ে আমিনার হাত ধরে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পর কৃষকের এই যে করুণ অবস্থা, তা থেকে এ দেশ আজও কি মুক্ত হতে পেরেছে?
এ রকম প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করা হয়তোবা অবাস্তব মনে হচ্ছে। কারণ দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ মার্চে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন ১০-১২ টাকায়। সে কৃষককে বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু কিনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। শুধু আলু নয়, সব কৃষিপণ্যেই একই অবস্থা। শুধু উন্নতি হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের। আসলে সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলিয়েও কৃষকের ভাগ্যের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হচ্ছে না। কোনো রকমে খেয়েপরে বেঁচে আছেন কৃষক। যেমনটা হয়েছিল মহেশ গল্পে গফুর মিয়ার। এসব কথা বলার কারণ হচ্ছে, ১ অগ্রহায়ণ, জাতীয় কৃষি দিবস পালিত হলো। দিনটি শুধুই কৃষকদের জন্য ছিল। তাদেরকে ও তাদের কাজকে সম্মানের জন্য এ আয়োজন করা হলেও কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি?
হাজারো দিবসের মধ্যে একটি দিবস নির্ধারিত হয়েছে, যাতে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। মনে আছে, ২০০৮ সালে যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট, বাংলাদেশে দুই দফা বন্যা এবং সিডরের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ কমে গিয়েছিল এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারেনি। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রফতানির ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন টালবাহানা শুরু করে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় নেতাদের বোধোদয় হয়। তারা বুঝতে পারেন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১ অগ্রহায়ণকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১ অগ্রহায়ণ পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে।
কৃষি দিবস পালনের ক্ষেত্রে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যে কৃষকের জন্য এ দিবস পালন করা হয় তাদের ভাগ্য কি আজও পরিবর্তন হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কৃষকের বর্তমান দুর্দশা মৌসুমি নয়; তা অব্যাহত থাকে সারা বছর। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না এবং বছরজুড়ে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। কৃষকের সংকট নিয়ে সারা বছরই ঘুরে-ফিরে এসব কথা বলে আসছি। কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষকের ফসল উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়লেও প্রকৃত কৃষক উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না। এখানে লাভের অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। প্রতি বছর লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষক ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে কাজ শুরু করেন।
আমি নিজেও একজন কৃষক পরিবারের ছেলে। ফসল ফলাতে গিয়ে একজন কৃষকের কী রকম শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন হয় তা আমার জানা। এ দেশের কৃষকরা হরতাল করতে পারেন না, তারা দুর্বল কণ্ঠ নিয়ে তাদের ন্যায্যমূল্য ও ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও জানেন না। কৃষির ওপর নির্ভরশীল এ দেশে কৃষকের ভাগ্য নিয়ে এ খেলা আর কত দিন চলবে—এ প্রশ্ন নীতিনির্ধারকদের কাছেই রইল।