
মার্কিন ভিসা নীতি জনগণের জন্য শাপে বর হয়েছে
বদরুদ্দীন উমর, লেখক-গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক। তাঁর জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর; ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উমর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন এবং গবেষণামূলক লেখালেখিতে নিয়োজিত হন। উমর জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ও ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকার সম্পাদক
নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে সংকট চলমান। কিন্তু এটা কি শুধু নির্বাচনী সংকট, নাকি রাজনীতিরই সংকট? এর শুরুটা কোথায়?
বদরুদ্দীন উমর: স্বাধীনতার পর থেকে যে অবস্থা চলছিল, তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি। কাজেই এটা নতুন কিছু নয়। দেশে এই যে শাসক শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, এটি গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে হয়নি। দুর্নীতি ও লুটতরাজের মাধ্যমে হয়েছে। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ২৫ লাখের বেশি বিনিয়োগ করা যেত না। কিন্তু একটি গোষ্ঠীর হাতে কোটি কোটি টাকা চলে এলো। এসব টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবে? কারণ, শিল্পে তো পারবে না। সেখানে করতে গেলে অনুমতি লাগবে। অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় কালো টাকা নামল; বৈদেশিক বাণিজ্যে হলো চোরাকারবার। এর মধ্য দিয়ে যে শ্রেণিটা গঠিত হলো, শাসক শ্রেণির সব দল তো সেখান থেকেই এসেছে। তারাই এখন ক্ষমতায়।
এই দলগুলোই তো এক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিল। বিশেষ করে ৮০-এর দশকে সেনা শাসকের বিরুদ্ধে তাদের গণতান্ত্রিক ভূমিকা ছিল।
বদরুদ্দীন উমর: তারা যে আন্দোলন করেছে, এটিকে প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যাবে না। তারা এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। আবার জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ এরশাদের নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেছে। কাজেই কথা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপাদান তাদের আন্দোলনের মধ্যে ছিল না। শুধু সরকার হটাওয়ের কথা। যেটি পরের দিকে গিয়ে দেখা গেল এক আওয়াজ– এরশাদ হটাও। ৫ দফা ১ দফা থেকে এলো ১ দফা– এরশাদ হটাও।
এখনও তো বিএনপি আবার ১ দফার আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে।
বদরুদ্দীন উমর: বিদ্যমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন মানেই তো গণতান্ত্রিক আন্দোলন নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের যেসব অধিকার স্বীকার করে নেওয়া দরকার; গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেভাবে কাজ করা দরকার; সেই দাবিগুলোর পক্ষে লড়াই থাকতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে তা ছিল না; বিএনপির মধ্যেও নেই।
বিএনপি সরকার পরিবর্তন করতে চায়। কারণ, নির্বাচন যথাযথভাবে হয়নি। তা ছাড়া দেশের মানুষ বহুভাবেই কষ্টে আছে। এর প্রতিকার চাওয়ার আন্দোলন কি গণতান্ত্রিক?
বদরুদ্দীন উমর: এতক্ষণ আমি যেভাবে বললাম, তাতে বিএনপির শ্রেণি চরিত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো পার্থক্য নেই। তবে আওয়ামী লীগ আরও পাকা; তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা অনেক বেশি। এসব কারণে বিএনপির চাইতে আওয়ামী লীগ আরও বেশি খারাপ। কিন্তু শ্রেণিগতভাবে তারা একই। ’৯০ সালের পর যেসব সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে তো কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা দেখা যায়নি। গণতান্ত্রিক কোনো কার্যকলাপও দেখা যায়নি। জনগণকে দমন-পীড়ন করেই তারা ক্ষমতায় থেকেছে। যে জন্য একবার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয়বার কেউ আসে না। আসেওনি। এই হচ্ছে এখানকার রেকর্ড। এই রেকর্ড নিয়েই ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। তখনই শেখ হাসিনা বুঝে গেছেন– তাদের আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বার নির্বাচন হলে আর থাকবে না। কাজেই তখন থেকেই আওয়ামী লীগ ঠিক করে রেখেছে– নির্বাচন ঠিকমতো করতে দেওয়া যাবে না। এ জন্য ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে তারা যেভাবে নির্বাচন করেছে; তাতে দেখা গেল ১৫৩ জন নির্বাচনের আগেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের চেষ্টা হলো আইনসিদ্ধ কৌশলেই নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। এটা তারা ২০১৪ সালে করেছে, আবার ২০১৮ সালে করেছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, তারাই বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ শাসক। যেভাবে তারা কথা বলে– বিরোধী দলকে এই করতে দেব না, ওই করতে দেব না; তাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারাই বাংলাদেশের মালিক। অথচ আওয়ামী লীগ অন্য রাজনৈতিক দলের মতো একটি দল। তারা তো কোনো বিশেষ দল নয়, যাদের অন্যদের চেয়ে বেশি অধিকার আছে। নির্বাচন তো আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক নয়। কারণ, নির্বাচন হলে তারা থাকবে না। কাজেই আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে– আর নির্বাচন হতে দেওয়া যাবে না। নির্বাচনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে নির্বাচন হলে তারাই জিতে।