![](https://media.priyo.com/img/500x/https://cdn.ajkerpatrica.net/contents/cache/images/720x0x1/uploads/media/2023/03/06/5819d3ff317337f0c8d92df2aaa4fbe2-64056d1889067.jpg)
বাংলাদেশ প্লাস্টিকমুক্ত হচ্ছে
একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ানটাইম) প্লাস্টিক থেকে দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপে সব সরকারি দপ্তরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলে পানি রাখার জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এমনকি সরকারি আমন্ত্রণপত্র, নিমন্ত্রণপত্র, ভিজিটিং কার্ড এবং ফাইল-ফোল্ডারে প্লাস্টিক ব্যবহার ও লেমিনেটিং ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে। প্রথমেই সরকারের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়া সফল করে তুলতে জনপরিসরের সামগ্রিক অংশগ্রহণ ও পরিবেশ-মনস্তত্ত্বকে তৎপর করার প্রস্তাব রাখছে।
পলিথিন-প্লাস্টিক এক জ্যান্ত পুঁজিবাদী পাপ। তীব্র ভোগবাদিতা আর নয়া উদারবাদী করপোরেট বাজার পৃথিবীকে প্লাস্টিকের তলায় খামচে ধরেছে। মাটি কিংবা মানুষ আজ প্লাস্টিকের কারণে শ্বাস নিতে পারছে না। সমুদ্র থেকে শুরু করে রক্তকণিকা—সর্বত্রই মিলছে প্লাস্টিকের দগদগে ক্ষত। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সূত্র দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশে কঠিন বর্জ্যের ১০ শতাংশই প্লাস্টিক। এর ভেতর ৬০ ভাগই একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় এবং বাকি ৪০ শতাংশ পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা যায়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দেশে উৎপাদিত হয় বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭৪৪ টন। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধে প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলার ৪০টি উপজেলাকে বেছে নিয়েছে সরকার।
কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা কি প্লাস্টিক বর্জন করতে প্রস্তুত? বিশেষ করে প্লাস্টিক যখন আমাদের খাদ্যরুচি থেকে শুরু করে দিনযাপনের প্রতিটি পর্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা জানছি প্লাস্টিক বিপজ্জনক, কিন্তু আমাদের মনস্তত্ত্ব আর অভ্যাস প্রতিদিন প্লাস্টিক জাপটে বড় হচ্ছে। পানির বোতল শেষ করার পর বারবার একে আবারও পানির বোতল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজার থেকে কিনছি প্লাস্টিক মোড়ানো খাবার, মাছ ঢুকছে পলিথিনে, প্লাস্টিক মুড়িয়ে দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখছি খাবার। দুধ রাখছি প্লাস্টিকে, প্রসাধনের প্লাস্টিক কৌটা ব্যবহার করছি বহুবার। লুডুর ছক্কা থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলনা প্লাস্টিক, প্রবীণের জুতা প্লাস্টিক। পাড়ায় পাড়ায় দুম করে গায়েব হলো রংতুলির দোকান। অনুষ্ঠানের মঞ্চ দখল করল সর্বনাশা প্লাস্টিক পিভিসি ব্যানার। নির্বাচনের পোস্টার পর্যন্ত ঢেকে দিল প্লাস্টিক। রান্নাঘর থেকে বিছানা—সব আজ প্লাস্টিকময়। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কেবল রাষ্ট্র এককভাবে সিদ্ধান্ত আর প্রকল্প গ্রহণের ভেতর দিয়ে কি দেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে পারবে? কোনোভাবেই সেটি সম্ভব নয়। যদি না আমরা করপোরেট নয়া উদারবাদী বাজার আর ভোগবাদকে প্রশ্ন না করি কিংবা প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সক্রিয় জন-আন্দোলন গড়ে না তুলি।
দেশজুড়ে এখানে-সেখানে প্লাস্টিক বোতল, প্যাকেট আর মোড়কের ভাগাড়। এত প্লাস্টিক আসে কোথা থেকে? কারা বানায়? কী থাকে এসব প্লাস্টিকের মোড়ক আর ধারকে? যা থাকে তা না খেলে, ব্যবহার না করলে কি জীবন বরবাদ হয়ে যায়? না, যায় না। কারণ, এসব মোড়ক ও ধারকে যা থাকে তা খাদ্য, পানীয় কিংবা প্রসাধন হলে এসব না ব্যবহার করেও দুর্দান্ত এক স্বাস্থ্যকর দীর্ঘ জীবন পাড়ি দেওয়া যায়। তাহলে এত পণ্য যায় কোথায়? আর এর বহুল ব্যবহারই যদি না হয়, তবে এই সব পণ্য এত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে কীভাবে? শোনা যায়, ক্ষুধা নিবারণ বা পুষ্টি নয়, এসব গিলতে হয় স্রেফ ‘বানোয়াট সামাজিক স্ট্যাটাস’ রক্ষার ঠেলায়। কোক-পেপসি না হলে নাকি ‘স্মার্টনেসের জাত যায়’! আর ঘাম ঝরিয়ে এই ‘জাত-কুল’ বাঁচাতে পৃথিবী হয়ে উঠছে বিপজ্জনক প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়। এসব করপোরেট কোম্পানির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে।
প্লাস্টিক কেবল মাটি, পানি, বাতাসের জন্য বিপজ্জনক নয়, মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতিতেও নির্দয়ভাবে ঢুকে যাচ্ছে প্লাস্টিক। আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের ভেতরও প্রবেশ করছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্লাস্টিকবিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক তাদের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। এই সমীক্ষা তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করেছে, কোক-পেপসি এবং নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমেই দুনিয়ায় ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। ২০১৯ সালে ৫১টি দেশে জরিপটি করা হয় এবং দেখা যায়, ৩৭টি দেশে কেবল কোকা-কোলার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটে। টিয়ারফান্ডের অপর একটি সমীক্ষা জানায়, ছয়টি উন্নয়নশীল দেশে পাওয়া ৫ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য কোক-পেপসি ও নেসলে দায়ী। প্রতিবছর পৃথিবীতে উৎপন্ন ৯১ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার না হয়ে পরিবেশে বিপজ্জনক বর্জ্য হিসেবে জমা হয়।