কর্মজীবী নারীর স্বাস্থ্য কতটা সুরক্ষিত
সুপর্ণা মফস্বল শহরের মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বিয়ের পরে স্নাতক শেষ করেছিলেন। এরপর সংসার আর সন্তান সামলে পড়াশোনাটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বামী সৌরভ ঢাকায় একটি বস্ত্র বিপণন প্রতিষ্ঠানে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে কাজ করতেন। বেতন ৪০ হাজার টাকা, সঙ্গে অন্যান্য সুবিধা। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিল।
কিন্তু বাদ সাধল করোনা মহামারি। চাকরি হারালেন সৌরভ, পরিবার নিয়ে ঢাকা ছাড়তে হলো তাঁকে। করোনা মহামারির পরে সুপর্ণাও ঢাকা এসেছেন স্বামীর সঙ্গে। ছেলেকে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন। সরকারি খরচে তিন মাস কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সুপর্ণা। সৌরভ কোনোমতে একটি চাকরি জোগাড় করেছেন। বেতন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁর একার আয়ে সংসারের চাকা ঘোরানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই সুপর্ণা একটি ডাটা এন্ট্রি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ছোট অফিস। লোক কম, কাজ বেশি। সারাদিন কাজের চাপে চেয়ার ছেড়ে ওঠার ফুরসত মেলে না তাঁর। অফিসে নারীদের জন্য আলাদা শৌচাগার না থাকায় তা খুব একটা ব্যবহার করেন না সুপর্ণা। কিছুদিন পরে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পিঠে অনেক ব্যথা। সঙ্গে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানে প্রধান অবদান হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্র উৎপাদন শিল্পের। এক কথায় বলতে গেলে, এ ক্ষেত্রে নারীরাই নগরীর প্রধান শ্রমিক এবং দেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের সূচকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অসামান্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। একটা সময় ছিল যখন নির্দিষ্ট কিছু পেশাকে নারীর পেশা হিসেবে মনে করা হতো।
কিন্তু বর্তমানে মানুষ সেই গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর অংশগ্রহণ এখন চোখে পড়ার মতো। ২০১৫ সালের ৩১ মে সর্বপ্রথম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ২৮ জন নারী ট্রাফিক সার্জেন্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঢাকার রাস্তায় নারী সার্জেন্টদের পদচারণা।
তারপর নারী ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সাধারণত একজন নারী ট্রাফিক সার্জেন্ট বা একজন নারী কনস্টেবলকে সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের একাধিকবার শৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ পুলিশ বক্সে শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। তাহলে এই দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকালে একজন নারী ট্রাফিক কীভাবে শৌচাগারের প্রয়োজন মেটাবেন? দেখা যায়, যখন খুব জরুরি প্রয়োজন পড়ে তখন তাঁরা আশপাশের বাস কাউন্টার বা শপিংমলের টয়লেট ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সারাদিনেও টয়লেট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন।
কিন্তু মাসের বিশেষ দিনগুলোতে ঘটে মহাবিপত্তি। দীর্ঘ সময় ধরে ন্যাপকিন পরিবর্তন না করার ফলে নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন এই নারীরা। আরেকটি চ্যালেঞ্জিং পেশা হলো সাংবাদিকতা। মাঠপর্যায়ে রিপোর্ট করতে হয়, এমন নারী সাংবাদিকরা একই সমস্যার সম্মুখীন হন। কখনও কখনও আট-দশ ঘণ্টায়ও শৌচাগারে যাওয়ার সুযোগ হয় না তাঁদের। তাঁরা শৌচাগার ব্যবহার করেন মাঠে যাওয়ার আগে এবং বাসায় বা কর্মস্থলে ফেরার পর। শৌচাগার ব্যবহারের অসুবিধার কারণে তাঁরা পানি কম পান করেন। শৌচাগারে যাওয়ার ভয়ে পানি কম খাওয়া, টয়লেট চেপে রাখা এবং মাসিককালীন অব্যবস্থাপনায় তাঁদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়।