নারী কৃষক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ'ল, পুরুষ চালাল হল,/ নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।/ নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে'/ ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে!" কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর অবদানের এমন স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবিক অর্থে ফসলের মাঠে নারীদের ভূমিকা স্বীকৃত নয়। যদিও বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে মোট নারীর মধ্যে শুধু কৃষিতেই নিয়োজিত ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কৃষিতে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ নারী বিনামূল্যে শ্রম দেয়; বাকি ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ নারী পারিশ্রমিক পায়। দেশের শ্রম জরিপ ২০১৬-১৭ এর তথ্যানুসারেও নারীদের কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশই কৃষিতে। এই বিপুল নারী শ্রমশক্তির ৬৮ শতাংশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে জড়িত। মোদ্দা কথা, ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারী সরাসরি অংশগ্রহণ করে। এত পরিসংখ্যান থাকার পরও কৃষক হিসেবে নারীর স্বীকৃতি নেই।
কৃষিতে নারীর ভূমিকা সামাজিক দৃষ্টিতে গৌণ হওয়ার পেছনে অন্যতম যে কারণটি কাজ করছে বলে মনে হয় তা হলো, কৃষি উৎপাদনের মূল কাজের সঙ্গে নারীরা জড়িত থাকলেও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সংযোগ একেবারেই সীমিত। এমনিতেই কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সেই দৌড়ে নারীরা একেবারেই পেছনের সারিতে। ফলে নারীরা বাংলাদেশে কৃষিপণ্য থেকে অর্জিত আয়ের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। যার দরুন কৃষক হিসেবেও তাদের স্বীকৃতি অনুপস্থিত।
নারীদের হাতে ফসলের জমিও অনুপস্থিত। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ৮১ শতাংশ জমির মালিকানা পুরুষের দখলে। নারীর হাতে মাত্র ১৯ শতাংশ জমি। সম্পদে অভিগম্যতায় নারীরা বৈষম্যের শিকার। তা ছাড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় আইন অনুসারেও নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পায় না। এখনও গ্রামের প্রচুরসংখ্যক নারী উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত। এমনকি শহরেও বাবার সম্পত্তির ন্যায্য ভাগ পায় না অনেক নারী। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইট অনুসারে, ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অথচ ভূমির ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা নেই। বাজার ব্যবস্থায়ও নেই তাদের প্রবেশাধিকার। এ কারণে তারা অধিকতর ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকদের সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন নেই।
ফসল উৎপাদনের প্রাথমিক কাজ, বপন, ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ এককভাবে নারী করলেও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে তাদের স্বীকৃতি অনুপস্থিত। মূলত কৃষিতে নারীর কাজকে নারীজীবনের প্রাত্যহিক বিনাশ্রমের সাংসারিক কাজ হিসেবেই বিবেচিত। যারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, সেখানেও নারী মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা ফসলের মাঠে যে শ্রম দেয়, তার ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশের জন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। আর বাকি ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশের জন্য তারা যে পারিশ্রমিক পায়, তা বাজারমূল্যের চেয়ে কম। কৃষিকাজ করতে গিয়ে নারীদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, জমির অভাব, অর্থায়নের সংকট, বাজারে নারীদের অভিগম্যতার অভাব, কৃষি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার অভাব, কম মজুরি, চিকিৎসার অভাবসহ নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হতে হয়। এর ফলে নারীদের ফসলের মাঠে তীব্র বৈষম্য মোকাবিলা করতে হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষিকাজ
- মজুরি বৈষম্য
- নারীর অংশগ্রহণ