পরিণত অর্থনীতির নতুন দিনের চ্যালেঞ্জ
প্রতি বছরের মতো এবারো অনেক উৎসাহ আর উদযাপনের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী ২০২৩ সালকে স্বাগত জানিয়েছে। সিডনি, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক, এমনকি ঢাকার আকাশেও দেখা গেছে হরেক রঙের আতশবাজি। বিগত বছরের শুরু আর শেষের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ করেছি। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পরবর্তী প্রথম বছর হিসেবে ২০২২ সালের শুরুটা অনেক ইতিবাচক ছিল। কারণ বিশ্বব্যাপী ভোক্তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং আশা করা হচ্ছিল যে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দা ভাব থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করবে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে সৃষ্ট সংকটের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির এ প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি থমকে যায়।
অনেক প্রত্যাশা থাকলেও ২০২২ সালটি ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভাষায়, ২০২২ সাল ছিল ‘নৈরাশ্যজনক, আরো অনিশ্চিত’। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি ও খাদ্যপণ্য খাতের সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। ইউক্রেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য রফতানি করে। রাশিয়া বিশ্বের বিশেষ করে ইউরোপের জ্বালানির বড় একটা অংশ সরবরাহ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি আর খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে এ দুটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। এ দাম বাড়ার ফল হিসেবে পৃথিবীব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় এবং পণ্যের সংকট দেখা দেয়। আইএমএফের সমীক্ষা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ৮-১০ শতাংশে পৌঁছে, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বায়নের কারণে বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতিই এখন অত্যন্ত সংযুক্ত আর যেহেতু বাংলাদেশ ক্রমেই একটি বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি হিসেবে বিকাশিত হচ্ছে, এ বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপক আর প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয়েছে।
বৈশ্বিক সংকটের কারণে শুধু রাশিয়া বা ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যই ব্যাহত হয়নি, সরবরাহ ব্যবস্থার বিপর্যয় আর বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় আমদানি পণ্যের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বৃদ্ধি পায়। টাকার অবমূল্যায়নের এ প্রভাব জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য খাত যেমন আমাদের ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) বা ভোগ্যপণ্য খাতেও দেখা দিতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আমি সাবান বা ডিটারজেন্টের মতো বহুল প্রচলিত পণ্যগুলোর কথা বলতে পারি। সাবান, ডিটারজেন্ট বা টুথপেস্টের মতো পণ্যগুলো দৈনন্দিন জীবনে সব শ্রেণীর মানুষ ব্যবহার করে এবং এ পণ্যগুলোর ব্যবহার দেখেই যেকোনো অর্থনীতির গতিবিধি ও ধারা বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া ইউনিলিভারের পণ্যগুলোর ৯৫ শতাংশেরও বেশি পণ্য বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। কিন্তু এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কাঁচামালের ৬০-৭০ শতাংশ আমদানিনির্ভর এবং আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করে থাকি। ২০২২ সালের বিশ্ববাজারে এসব শিল্প কাঁচামালের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যায় ও দাম বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে টাকার বিনিময় হার আর পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যয় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়েও অধিকাংশ পণ্যের দাম সমন্বয় করতে আমরা বাধ্য হই।