বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতার অপরিহার্যতা
কোনো সরকারি চাকরিজীবীকে নির্ধারিত সময়ে চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পর জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো প্রশাসনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ। এটি নতুন কিছু নয়। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা ব্রিটিশ যুগে ছিল, ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানে, রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে।
এ বিষয়ে আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন “এটি ঠিক যে আপিলকারীর (সরকার) এমন ক্ষমতা থাকা উচিত যাতে তারা কোন অবাঞ্ছিত, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ, বেয়াদব এবং অবাধ্য চাকরিজীবীকে অপসারণ করতে পারে। তবে সে ক্ষমতা ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হয়” (বিএডিসি বনাম শামসুল হক)। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট “দিল্লী ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন বনাম ডি.টি.সি মজদুর কংগ্রেস (১৯৯১)” মামলার রায়েও একই ধরনের কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য এ ক্ষমতা প্রশাসনের জন্য অপরিহার্য। মিনিস্টিরিয়াল রেসপনসিবিলিটি তত্ত্ব অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের অন্যায় বা অবহেলার দায়ভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের ওপরই বর্তায়, যার জন্য তাদেরকে সংসদে জবাবদিহি করতে হয়। ওই অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালে ১৪ নম্বর প্রেসিডেন্ট-এর নির্দেশে, প্রথম বাধ্যতামূলক অবসরের বিধানে বলা হয় ২৫ বছর চাকরি করেছেন এমন কোনো সরকারি চাকরিজীবীকে সরকার কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অবসরে পাঠাতে পারবে। এই বিধানটিই পরে ১৯৭৪ সালের পাবলিক সার্ভেন্ট রিটায়ার্মেন্ট অ্যাক্টের ৯(২) ধারায় বলবত করা হয়। তবে ১৯৭২ সনেই যে এর প্রথম প্রচলন করা হয়েছিল তা নয়, এ ধরনের আইন এবং ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজত্বের সময় এবং পাকিস্তান আমলেও ছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনকালে এই আইনের প্রয়োগের ব্যাপকতা ছিল তুঙ্গে, অপপ্রয়োগও ছিল সীমাহীন। বিএনপি-জামায়াত সরকার অযৌক্তিকভাবে বহু কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে নিকৃষ্টটি ছিল জিয়াউর রহমান কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, দেশের একজন বিরল মেধার চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. নুরুল ইসলামকে তার পদ, যথা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন ইনস্টিটিউট-এর পরিচালকের পদ থেকে ১৯৭৮ সালে অবসরে পাঠানোর ঘটনা। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর আশির্বাদপুষ্ট ছিলেন বলেই ডা. নুরুল ইসলামের ভাগ্যে এমনটি ঘটেছিল। ডা. নুরুল ইসলাম শুধু জিয়া সরকারের সিদ্ধান্তই চ্যালেঞ্জ করেননি, তিনি ১৯৭৪ সালের আইনের ৯(২) ধারা, অর্থাৎ সরকারি চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা প্রদান করা আইনের বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে আপিল বিভাগ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আইনটি এই বলে অবৈধ করে দেন যে এতে কোনো গাইডলাইন ছিল না, অর্থাৎ সরকার কোন পরিস্থিতিতে ২৫ বছর চাকরিসম্পন্ন করা ব্যক্তিকে অবসরে পাঠাতে পারবেন, তার কোনো গাইড লাইন ছিল না, শুধু বলা ছিল ২৫ বছর চাকরি শেষ করে থাকলে যে কাউকে অবসরে পাঠানো যাবে। এভাবে আইনটি বাতিল হওয়ার পর সরকার পুরানো বাতিল হওয়া আইনের সাথে ‘জনস্বার্থে’ কথাটি সংযোজন করে পার্লামেন্টে নতুন আইনের প্রস্তাব করলে তা গৃহীত হয়। নতুন আইনটিতে ‘জনস্বার্থে’ কথাটি থাকায়, আগে যা ছিল না, এটি বৈধতাপ্রাপ্ত হয়, কেননা ‘জনস্বার্থে’ কথাটি যথোপযুক্ত গাইডলাইন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৮ সালে যে নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়, তার ৪৫ ধারায় ‘জনস্বার্থে’ এই ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাধ্যতামূলক অবসর