সমাজ সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতেই
আগের দিনের কথা বুকে হাত দিয়ে কী বলতে পারি যে তখন আমরা খুব ভালো ছিলাম? না, মোটেই না। ভালো তখনো ছিলাম না, এখনো নেই। তবে বুকভাঙা দুঃখ এখানে যে তখনকার খারাপ অবস্থাটা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, প্রাণ দিয়েছি, আমাদের মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। হ্যাঁ, সংগ্রাম করে আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু সর্বত্রই তো দেখতে পাই পরাজয়ের চিহ্ন। মনে হয় আমরা পরাজিত হয়ে গেছি। সেটা এই বিশেষ অর্থে যে উন্নতি আমাদের মুক্তি দেয়নি। উন্নতিটা মানবিক হয়নি, হয়েছে শত্রুভাবাপন্ন। এককথায় পুঁজিবাদী।
কুষ্টিয়ার ওই মানুষটার কথা ভাবা যাক। কাজী আনিসুর রহমান নাম। মধ্যবয়সী। সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন। কবিতা লিখতেন, ছাপাতেনও। ঢাকায় আসতেন, বইমেলাতে। আর্থিক অবস্থা নিতান্ত খারাপ ছিল না তাঁর। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তও ছিলেন এবং নগদ এক কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছিলেন, ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। কথা ছিল বন্ধু তাঁকে মাসে মাসে মুনাফা দেবেন। একেবারেই যে দেননি, তা-ও নয়। দিয়েছেন। বন্ধুর শিল্পপ্রতিষ্ঠান যে দেউলিয়া হয়ে গেছে, এমনও নয়। বন্ধুটি ভালো মুনাফা করেছেন, তাঁর সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু হায়, কাজী আনিসুর রহমান শিকার হয়েছেন বঞ্চনার। মাসওয়ারি আয়টা বন্ধ হয়ে গেছে। আনিসুর রহমান এখন কী করবেন? কার কাছে বিচার চাইবেন? কে বিচার করবে? বন্ধুর কাছে তাঁর পাওনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। টাকার হিসাব আছে, কিন্তু বন্ধুর দেখা নেই। রাজনৈতিক বন্ধুরা যে এগিয়ে আসবেন, তা-ও ঘটেনি। ওদিকে আনিসুর রহমান যে টাকাটা লগ্নি করেছিলেন, এর সবটা তাঁর নিজের ছিল না, আপনজনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সেই আপনজনেরা এখন টাকা ফেরত চাইছেন। অসহায় আনিসুর রহমান ঘটনাটা জানাতে চেয়েছিলেন সমাজের কাছে। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এসেছেন। সংবাদ সম্মেলন করবেন? কীভাবে? কে দেবে সাড়া? অসহায় আনিসুর রহমান তাঁর ফরিয়াদটা জানানোর জন্য জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন নিজের গায়ে। বাঁচেননি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। রূপকথা নয়, সত্য কথা। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরের কথা। যুদ্ধাপরাধীর নয়; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন মানুষের অগ্নিদগ্ধ প্রস্থানের কথা। অকল্পনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।
আগের দিনের মানুষের মুখে একটি প্রবচন শোনা যেত, ‘ডালিম পাকিলে পরে আপনি ফেটে যায়, ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে ঠকায়।’ ছোটলোক বলতে তখন গরিব লোককেই বোঝাত। গরিব মানুষ মনের দিক দিয়েও দরিদ্র। নৈতিকতায় নিতান্ত খাটো। তক্কে তক্কে থাকে, অন্য কাউকে না পেলে নিজের বন্ধুকেই ঠকায়। এ রকমের ছিল ধারণা। ধারণাটা ভ্রান্ত ছিল, সন্দেহ কী। গরিব মানুষ হঠাৎ করে ধনী হয়ে যাবে, এটা এখন সম্ভব নয়, তখনো সম্ভব ছিল না। তবে হ্যাঁ, ঠকানোটা চলত। ঠকানো এখনো চলে, কিন্তু অধিকতর প্রশস্ত পথে। লুণ্ঠন নির্বিঘ্নে চলছে। ব্রিটিশ আমলে রেল কোম্পানি যাত্রীদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ট্রেনের কামরায় লিখে রাখত, ‘সাবধান, চোর-জোচ্চোর আপনার নিকটেই আছে।’ তা ট্রেনের কামরার শুধু বদনাম কেন, চোর-জোচ্চোরের তৎপরতা এখন সর্বত্র এবং সমাজে তারাই সম্মানিত, যারা ওই সব তৎপরতায় দক্ষ। কে কাকে সাবধান করবে? আর এটাও তো সত্য যে ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেরা ছ্যাঁচড়া চোর-ডাকাত ছিল না; ছিল অত্যন্ত উঁচুমাপের দস্যু ও তস্কর। তাদের কার্যাবলির কারণেই আমরা দরিদ্র হয়েছি এবং তাদের আচরিত আদর্শে দীক্ষিত হয়েই তো আমরা উন্নত হওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছি।